ওদের শিক্ষা আর আমাদের শিক্ষা

studentsমানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা দানে বিশ্বে এখন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফিনল্যান্ড। ২০০০ সালের আগেও যে দেশটির নাম শোনা যেত না, সেই ফিনল্যান্ডই মানসম্মত শিক্ষায় ভাবিয়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকেও।

দেশটিতে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি। সবই এক মানের। সব স্কুলেরই লক্ষ্য এক। তাই প্রতিযোগিতা নেই। পুরো প্রাথমিক জীবনে কোনো পরীক্ষা নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির পর সমাপনী পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা বাধ্যতামূলক নয়। ক্লাস টিচার যদি মনে করেন, তবেই পরীক্ষায় বসে শিশুরা। এ পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয় না। হোমওয়ার্কের বালাই নেই বললেই চলে। স্কুলে শিশুদের বেশি সময় কাটে খেলাধুলায়। পড়া পারলে পুরস্কার হিসেবে খেলার সুযোগ পায় শিশুরা।

আশির দশকে ফিনল্যান্ড সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মাস্টার্স থাকলেই হবে না, শিক্ষকদের পাঁচ বছরের তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক শিক্ষা থাকতে হবে, যা নিতে হবে আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি থেকে। খরচ বহন করবে সরকার। শিক্ষকদের মর্যাদা উন্নীত করা হয় ডাক্তার ও আইনজীবীদের সমান। কেবল উঁচু বেতন-ভাতার জন্যই নয়, পেশার স্বাধীনতার সম্মান ও সামাজিক মর্যাদার কারণেও প্রাথমিক শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের তীব্র আগ্রহ। ২০১০ সালে ৬৬০টি প্রশিক্ষণার্থী পদের জন্য ছয় হাজার ৬০০ দরখাস্ত পড়ে।

সাড়ে তিন হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬২ হাজার শিক্ষক, সবাই স্নাতকোত্তর। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে সবচেয়ে ভালো ফল করা সর্বসেরা ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাছাই করা হয় প্রাথমিক শিক্ষক। তাদের সবাই একই মানের। দুর্বল-সবল, গ্রাম-শহর, বড় শহর-ছোট শহরভেদে শিক্ষক নিয়োগ হয় না। তাই শিক্ষার মানেরও হেরফের হয় না ওই দেশে। রাজধানী হেলসিংকির একটি কম্প্রিহেনসিভ স্কুলের ১৫০ শিক্ষার্থীর অর্ধেকই বিদেশি। বাংলাদেশিও রয়েছে কয়েকজন। শিক্ষক ৩০ জন। ‘আমরা দুর্বলদের গড়ি। আমাদের অত তাড়াও নেই।

শিশুরা যখন তৈরি হবে, তখনই ভালো শিখতে পারবে। পীড়াপীড়ি করতে হবে কেন’, এভাবেই বলেন অধ্যক্ষ লুইভম তাঁদের মূলনীতি সম্পর্কে। অঙ্ক, বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দেওয়া হয় দেশটিতে। পাশাপাশি গান, আঁকা, হাতের কাজ শেখানো হয় বাচ্চাদের। ধর্মও পড়ানো হয়। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা ফিনিস-এ, তৃতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি, চতুর্থ শ্রেণিতে সুইডিশ, পঞ্চম থেকে জীববিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়ানো হয়। ছয় বছর বয়সে শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। স্কুলেই বিনা মূল্যে খাবার, চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাতায়াতের ব্যবস্থাও করে স্কুল। বিশেষ চাহিদার শিশুদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। অবশ্য এ জন্য বাড়তি খরচ দিতে হয়। সাত বছর বয়সের আগে স্কুলে আসা বাধ্যতামূলক নয় ওই দেশে।

ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষায় এই বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটানো হয় ৪০ বছর আগে। সংসদে আইন পাস হয়, প্রতিটি শিশু পাবে মানসম্মত সরকারি শিক্ষা। ৭-১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা পড়বে কম্প্রিহেনসিভ স্কুলে। সপ্তম থেকে নবম নিম্ন মাধ্যমিক, দশম-দ্বাদশ উচ্চ মাধ্যমিক। সুদূরপ্রসারী এই কর্মপরিকল্পনার ফল পেতে শুরু করেছে দেশটি।

প্রগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টে (পিআইএসএ) ফিনল্যান্ডের শিশুদের বিশ্বের সবচেয়ে সেরা পড়ুয়া হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বিশ্বের ৫৭ দেশের পাঁচ লাখ শিশুর মধ্যে প্রতিযোগিতায় বিজ্ঞান ও অঙ্কে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে ফিনল্যান্ডের শিশুরা। শিক্ষায় সমতার গুরুত্ব নিয়ে একমত ফিনল্যান্ডের সরকারি দল, বিরোধী দল সবাই।

দক্ষিণ কোরিয়ায় ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা। তার আগে এক বছর প্রাক-প্রাথমিক। ভর্তিযুদ্ধ নেই। সন্তানের পাঁচ বছর বয়স হলেই স্থানীয় প্রতিনিধির কাছ থেকে চিঠি পান অভিভাবক। তাঁকে জানানো হয়, এলাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর সন্তানের ভর্তি হয়ে গেছে।

ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার ঠিক বিপরীত চিত্র যেন বাংলাদেশে। বিষয়টা যেন এমন—সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী শিক্ষকতায় আসবেন। প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষকরা যোগ দেন প্রাথমিক শিক্ষায়। পরে শুধু একবার ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। এত দিন প্রাথমিকে মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এসএসসি এবং ছেলেদের এইচএসসি। তবে কয়েক বছর আগে তা ছেলেদের ক্ষেত্রে স্নাতক ও মেয়েদের ক্ষেত্রে এইচএসসি করা হয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগ পদ্ধতির পুরোটাই ছিল ত্রুটিপূর্ণ। টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন বেশির ভাগ শিক্ষক। মেধার কোনো মূল্য দেওয়া হয়নি। আর ক্লাসরুমে পড়ানোর পদ্ধতিও ভিন্ন। নির্দিষ্ট বই ছাড়া এক্সট্রা কারিকুলাম কার্যক্রম খুব একটা দেখা যায় না। শিক্ষকরা ক্লাসে আন্তরিক নন। ফলে শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হয় কোচিং-প্রাইভেটের ওপর।

কোথায় বাংলাদেশ: আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার মান, শিক্ষকদের দক্ষতা, অবকাঠামো, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিসহ কোনো বিষয়েই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের ধারেকাছে নেই বাংলাদেশ। আমাদের শিক্ষা যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে না। অবশ্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষার হাল কমবেশি বাংলাদেশের মতোই। শিক্ষকদের অদক্ষতা ও অনুপস্থিতি, উপকরণ ও অবকাঠামোর অপ্রতুলতা, শিক্ষক ও স্কুলের স্বল্পতা এসব দেশের প্রাথমিক শিক্ষার সাধারণ চিত্র। সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ভারতেও। ফলে দেশটিতে সরকারি থেকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তির হার বেড়ে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য ২০০৯ সালে প্রগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-পিসার মান নিরূপণে অংশ নিয়েছিল ভারত। ৭৩ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছিল ৭২তম, এর নিচে কেবল কিরগিজস্তান।

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ