টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বাড়ছে নিয়মিতই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে, যা এক বছর আগের তুলনায় ৩ টাকা ১৬ পয়সা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, সর্বশেষ গত এক মাসে ডলারের দাম ৭২ পয়সা বেড়েছে।
বাজারের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। বেশ কিছু ব্যাংক ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হারের চেয়ে বাড়তি মূল্য আদায় করছে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আর সাধারণ মানুষ, যাঁরা ভ্রমণ করতে বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের ডলার কিনতে হচ্ছে ৮৬ টাকার কাছাকাছি দরে।
ডলারের দামের এই তেজিভাবে কিছুটা উৎসাহিত হচ্ছে রপ্তানি খাত। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণও বেড়েছে। তবে এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্য আমদানির ব্যয়। কারণ, আমদানির জন্য বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে। ফলে খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামালসহ সব আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়ছে। এতে নির্বাচনের বছরে মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ডলারের দাম বাড়ার মূল কারণ রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেড়ে যাওয়া। দেশে চাল, গম ও অন্যান্য পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের চাহিদা। মূলধনি যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্র, উন্নয়ন প্রকল্পের উপকরণ আমদানি ইত্যাদি কারণে সার্বিক আমদানির চাপ বেড়েছে। সব মিলিয়ে বর্তমান ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মার্চ মাস শেষে চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭০৮ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।
এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। নতুন করে আমদানি শুরু হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)। ভবিষ্যতে কয়লা আমদানিও বিপুলভাবে বাড়বে। বিশ্ববাজারে পোশাকশিল্পের কাঁচামাল তুলার দাম অনেক বেড়ে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে খরচ কমার আশা নেই। কারণ, বিভিন্ন পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে আগামী দিনগুলোতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে ডলারের দামে স্বস্তি ফেরার আশাও কম।
সার্বিক পরিস্থিতিতে কপালে ভাঁজ পড়ছে ব্যবসায়ীদের। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। ডলারের দাম বাড়লে ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়। পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি জ্বালানির জন্য ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর হন, তাহলে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এমন চাপ তৈরি হবেই।’
পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়ছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৬ সালের মে মাসে ডলারের দাম ছিল ৭৮ টাকার ৪০ পয়সা। ২০১৭ সালের একই মাসে তা দাঁড়ায় ৮০ টাকা ৫০ পয়সার মতো। চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৮৩ টাকা ছাড়ায়।
অবশ্য সাধারণ মানুষ এ দরে ডলার কিনতে পারবেন না। বাজার থেকে ডলার কিনতে তাঁদের ব্যয় হচ্ছে প্রতি ডলারে ৮৬ টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানিতে ডলারের যে দাম নেওয়ার কথা ব্যাংকগুলোর, তা অনেকে মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অনেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দর মেনে ডলার বিক্রি করলেও ‘হ্যান্ডলিং চার্জের’ নামে আলাদা বিল ধরিয়ে দিচ্ছে।
অবশ্য চট্টগ্রামের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘কিছু ভালো ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে। অন্যরা মানছে না। কেউ কেউ আমাদের কাছ থেকে ইচ্ছামাফিক দর আদায় করছে।’ তিনি বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ডাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে কেজিপ্রতি আড়াই থেকে চার টাকার প্রভাব পড়ছে।
ডলারের দামের কারণে জ্বালানি তেলের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তার একটি হিসাব তৈরি করেছে বিপিসি। সংস্থাটির মতে, ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডলার ছিল ৭৯ টাকা, যা গত এপ্রিলে সাড়ে ৮৩ টাকা হয়েছে। একই সময়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ৪৩ থেকে বেড়ে ৭০ ডলার হয়েছে। এসব হিসাব তুলে ধরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। তারা আরও জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে যাবে বলে জ্বালানি তেলের চাহিদা ২০ শতাংশ বাড়বে।
কিছু ব্যাংকে সংকট বেশি
ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের ঋণপত্র খোলার আবেদন পড়ে আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (পিডিবি) এবং সরকারি উন্নয়নকাজের উপকরণ ও কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র।
রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, আগে প্রতি মাসে গড়ে বিপিসির চারটি ঋণপত্র খোলা হতো। ডলার সংকটের কারণে চলতি মাসে তারা কোনো ঋণপত্র খুলতে পারেনি। আগে প্রতি ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে ২ কোটি ডলার লাগত, তেলের দাম বাড়ায় তা ৪ কোটিতে উন্নীত হয়েছে।
আমদানি চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত ২১৪ কোটি ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকগুলো কাছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে হয়েছে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮৩ টাকা ৭০ পয়সা দামে প্রতি ডলার কিনতে হচ্ছে। এ দামেই ঋণপত্রের দেনা শোধ করতে হচ্ছে। সরকারি ঋণপত্রের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার দিলেও বেসরকারি খাতের জন্য ডলার দিচ্ছে না। ফলে বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে, এতে প্রতি ডলার ৮৫ টাকার বেশি পড়ে যাচ্ছে।
রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ছয় মাস আগে ঋণপত্র খোলার সময় কয়েকটি ব্যাংক তখনকার দাম স্থায়ী ধরেই গ্রাহকদের সঙ্গে ঋণপত্র নিষ্পত্তির চুক্তি করেছিল। এ সময়ে প্রতি ডলারের দাম ২ টাকা বাড়ায় এসব ব্যাংক এখন লোকসান গুনছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, কয়েকটি ব্যাংক না বুঝেই ঋণপত্র খুলেছে। আমদানি দায় শোধ করতে গিয়ে তারা ডলারের দাম বাড়িয়ে ফেলছে। ফলে গ্রাহকদের অনেকেই এখন ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো অনেক সতর্ক হয়ে গেছে।
আমদানি বেড়েছে ২৪ শতাংশ
চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সময়ে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৪ হাজার ৩৫৬ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ২৪ শতাংশ বেশি। এ সময়ে আমদানির ঋণপত্র খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ।
আমদানির তুলনায় রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অনেক কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সময়ে রপ্তানি আয় বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। আর প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১৭ শতাংশ।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলার সংকট কাটাতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানো ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। কারণ, ডলার সংকট চলতে থাকলে সবার ওপরই চাপ বাড়বে। -সুত্রঃ প্রথম আলো