Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
shipon
লেখক

ডিউটি শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি এই বুঝি বউ এসে এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুজতে গুজতে দরজা খুলে দেবে। দুই ছেলে বাবার ফিরে আসার আনন্দে খেলনাগুলো ছুড়ে ফেলে দুই পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদিত হয়ে তাদের প্রিয় চকলেট কিংবা চিপস খুঁজছে। আমি দুই জনকে বাহুতে চেপে পাশের সোফায় বসে তাদের সাথে খুনসুটিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

আমার স্ত্রী অনুযোগের স্বরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে, আমার হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে সন্তানদের শাসিয়ে ফ্রেশ হবার জন্য অনুরোধ করছে। মা এসে তার বউমাকে বকা দিয়ে বলছে, আহা! বউমা বাবা তার ছেলেদের সাথে একটু খেলুক না।

chardike-ad

পরক্ষণে ভাবি না আমি তো প্রবাসী। নিজেই দরজা খুলে ঘর্মাক্ত পোশাক নিয়েই খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে ফোনটা চার্জে কানেকশন দিয়ে ফেসবুকিং করতে করতে ঘণ্টাখানেক পার করে দেই। বউ ফোন দিয়ে জানতে চায় খেয়েছ? বলি না এখনই ফ্রেশ হব, রান্না করব তারপর খাব। বউ অভিমান করে বলে, এক্ষুনি যাও গোসল করে খাওয়া দাওয়া সেরে আমাকে কল দিয়ো। ফোনটা রেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রান্না ঘরে গিয়ে কোনো রকম রান্না করে গোসল করে খেতে বসে মনে হয়।

মা আমার জন্য খাবার তৈরি করে অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে। টেবিলে সাজানো আমার সব প্রিয় খাবারগুলো একে একে মা সব আমার প্লেটে তুলে দিচ্ছেন। আমি বারবার মাকে বাধা দিয়ে বলছি এত খেতে পারব না। আমি সব খেয়ে ফেললে আপনারা খাবেন কি? মা শাসন করে বলছে, আমাদের কথা তোমার চিন্তা করতে হবে না।

আমরা সারাদিন বাসায় থাকি আর তুমি তো আমাদের জন্য খেটে মরো। পাশ থেকে বাবা এসে বলছে, খা বাবা খা তোর মা তোর জন্য কষ্ট করে রান্না করেছে। ছেলে দুটি তাদের পড়া রেখে দৌড়ে এসে আমার দুই পাশে খালি চেয়ারে বসে বলছে, দাদি আমরাও বাবার সাথে ভাত খাব।

বউ আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেদের দেখে এগিয়ে এসে বলছে, আসো বাবারা আমি তোমাদের খাইয়ে দেই। ছেলেরা আহ্লাদিত করে বলছে না মা আমরা আব্বুর সাথেই খাব। হঠাৎ মনে পড়ে কি ভাবছি আবোল-তাবোল আমি তো প্রবাসী। আমার কপালে কি এত সুখ আছে? আমার মা তো আকাশের তারা হয়ে আছে।

নিজের হাতে নিজে খাবার তুলে বিষণ্নবদনে খাবার খেতে শুরু করি। বিছানায় এসে ভাবি এই বুঝি বউ বিছানা গুছিয়ে দিচ্ছে আর ছেলেরা আমার জায়গা দখল করে শুয়ে আছে। দুই ভাইয়ের যুদ্ধ লেগে গেল আমার পাশে শোয়ার জন্য। বাধ্য হয়ে দু’জনকেই বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু না এগুলো শুধুই আমার কল্পনা আমি তো প্রবাসী। নিজের বিছানা নিজেই গুছিয়ে কোনো রকমেই মাথা গুজে শুয়ে থাকি। অনেক সময় তো এলোমেলো বিছানা আর তেলছিটে বালিশের কাভারে মাথা রেখে শুয়ে থাকি।

অসুস্থতা মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী আমিও মাঝে মধ্যে অসুস্থতায় পড়ি। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানার এপাশ-ওপাশ করি আর ভাবি এই বুঝি মা আমার পাশে বসে মাথায় জলপট্রি দিচ্ছে আর আদুরে গলায় বকুনি দিচ্ছে। সারারাত তার চোখে ঘুম নেই। যেন আমি অসুস্থ নই সে নিজেই অসুস্থ। তার অস্তিরতা দেখে আমি উদ্বিগ্ন হই। মনে মনে আল্লাহকে বলি আল্লাহ মায়ের জন্য হলেও আমাকে আর অসুস্থ কর না। পরক্ষণেই মনে হয় আমি ভুলে যাই কি করে আমি তো প্রবাসী। এগুলো এখন শুধুই আমার কল্পনা। সুখী হবার ব্যর্থ চেষ্টা।

অসুস্থ শরীর নিয়ে একাকি রুমে কাতরাতে থাকি। কেউ নেই আমার পাশে বসে একটু আদুরে গলায় শাসন করবে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি সর্দি হলে। সর্দির কোনো সময় জ্ঞান নেই, কিছুদিন পরপর আমার সর্দি লেগে যায়। এইতো কিছুদিন আগে আমার সর্দি হয়। যাকে বলে ভয়ঙ্কর সর্দি।

নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি বেরুচ্ছে, যা হাত দিয়ে সামলানো প্রায় অসম্ভব। বিছানার চারপাশে যা পাচ্ছি তা দিয়েই নাকের পানি আটকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। ক্রমাগত হাঁচছি আর নাক ঝাড়ছিলাম। একটা সময় দেখা গেল আমার চারপাশে কোনো শুকনো কাপড় নেই। নাকের পানিতে সব একাকার।

এই ভয়ঙ্কর সর্দির কারণে রুম থেকে বের হতে পারছিলাম না। সিঙ্গাপুরে রাস্তায় থুথু ফেললে জরিমানা গুনতে হয় আর নাকের পানি ফেললে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। দেশে হলে একটা রোমাল হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতাম রোমাল ভিজে গেলে রাস্তায় নির্জন এলাকায় দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে জোরছে নাক ঝেড়ে জামার হাতায় নাকটা মুছে কিছু হয়নি এমন ভাব ধরে হেঁটে যেতাম।

কিংবা মায়ের হাতের সরষে ভর্তা, আদা গরম পানি খেয়ে কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম। একটু পর পর মা আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করত আর বকুনি দিত আমি কম্বলে মুখ ঢেকে মুচকি হাসতাম। আহা! এসব কি ভাবছি! কেন বারবার ভুলে যাই আমি প্রবাসী। যতই সর্দিই হোক আগামীকাল আমাকে অফিসে যেতেই হবে। এভাবেই আপনগৃহ ছেড়ে দূর পরবাসে একাকি কেটে যাচ্ছে দিন। তবুও মাঝে মাঝে কল্পনায় নিজের একাকিত্ব দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাই। জানি না এভাবে কতদিন।

সিঙ্গাপুর থেকে ওমর ফারুকী শিপন