মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়েছে। সক্রিয় আইনি সহায়তায় ১১ মাসে ৩ কোটি ৫ লাখ ৮ হাজার ৮৫৯ টাকার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে দেশটির বাংলাদেশ হাইকমিশন। এ ছাড়াও বকেয়া বীমার টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানান মিশনের সংশ্লিষ্টরা।
তবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা কর্মরত অবস্থায় বকেয়া, দুর্ঘটনা, মৃত্যু ও ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা কাজ করলেও বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক ধীরগতি ও হয়রানিসহ নানা কারণে বেশিরভাগ শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে চার বছর অতিবাহিত হলেও ক্ষতিপূরণ পায়নি বরিশালের মৃত ফজলু দফাদারের পরিবার। অভিযোগ উঠেছে দফায় দফায় প্রবাসীকল্যাণ অফিসে ধরণা দিয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছে না মৃতের পরিবার।
অভিযোগে জানা যায়, বরিশাল সদরের চরবুখাইনগর গ্রামের আছমত আলী দফাদারের ছেলে মালয়েশিয়া প্রবাসী মৃত ফজলু দফাদার পাসপোর্ট নং এফ-০৪৭৬৩৬৫ সিল নং-১২, ক্লেইম নং-৯৬/২০/২০১৬, তারিখ- ০৭/১১/২০১৭, তার মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাবদ হাইকমিশন থেকে মৃতের স্ত্রী চার কন্যার নামে পাঁচটি ৫ হাজার ৫৩ ইউরোর ড্রাফট প্রেরণ করা হয়।
মৃতের পরিবার ডিইএমও বরিশাল হতে ড্রাফট গ্রহণের পর জেলাটির বিভিন্ন ব্যাংকে ড্রাফটসমূহ জমা দিতে গেলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানান ড্রাফটগুলো ভাঙানো যাবে না। পরে মৃত ফজলু দফাদারের পরিবার ঢাকার ডাচ-বাংলা ব্যাংক, শান্তিনগর শাখায় জমা জমা দিতে গেলে ড্রাফটের মেয়াদ শেষ হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়।
ফলে মৃতের স্ত্রী শাহানূরের নামে একক চেক পাওয়ার জন্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ মূল ড্রাফট পাঁচটি ডিইএমওর মাধ্যমে হাইকমিশনে শ্রম কাউন্সিলরে ফেরত পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত দূতাবাস ক্ষতিপূরণের সুরাহা করতে পারেনি বলে এ প্রতিবেদককে জানান মৃত ফজলু দফাদারের স্ত্রী শাহানূর।
এ বিষয়ে দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে শ্রম শাখার কর্মকর্তা জানান, ক্ষতিপূরণের চেক সময়মতো তারা ব্যাংকে জমা না করায় এ সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধানের।
দূতাবাস সূত্র জানায়, হাইকমিশনার মহ.শহীদুল ইসলামের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও তার সার্বিক দিকনির্দেশনায় আইনি সহায়তায় দুর্ঘটনা, বকেয়া বেতন, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ আদায় বাবদ নিয়মিত চেক দূতাবাস থেকে পাঠানো হলেও বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাশিত ব্যক্তিদের নিকট হস্তান্তরে সময় শেষ হয়ে যায়। ফলে চেকটি নগদায়নে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
চেকটি পুনরায় মালয়েশিয়ায় ফেরত পাঠানো হয় এবং নতুন করে মালয়েশিয়ার শ্রম অফিসের মাধ্যমে পেতে অনেক সময় লাগে। শুধু তাই নয়, দেশটির শ্রম অফিসের কর্মকর্তারা মনোক্ষুণ্নও হন। এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণপ্রত্যাশীরা একের পর এক দেনার মধ্যে থেকে দিনাতিপাত করছেন।
এ বিষয়ে দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর, মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনা, মৃত্যু বা বকেয়া বেতন ও শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ আদায়ে আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ ছাড়া যাদের বৈধ ও কাগজপত্র সঠিক তারাই ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর এই ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাস সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকে।
বাংলাদেশি কর্মীরা ক্ষতিপূরণ পেতে যাতে কোনো হয়রানির শিকার না হয়, তার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে বলে শ্রম কাউন্সিলর জহিরুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন বীমার আওতায় বিদেশি কর্মীরা নিবন্ধিত হচ্ছেন। এর আওতায় দুই লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধিত হয়েছেন।
এ প্রক্রিয়ায় কোম্পানি সকসোর অধীনে কর্মীদের নাম নিবন্ধন করছে। বাংলাদেশ ২য় স্থানে থাকলেও ইন্দোনেশিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কর্মীরদের বীমার আওতায় আনবে কোম্পানি। তাদের বীমার আওতায় আনা হচ্ছে কিনা কর্মী তার মালিক পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে।
দেশটিতে কর্মরত বৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের শতভাগ বীমার আওতায় নিয়ে আসতে মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা নিরলস চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নিবন্ধন নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগকর্তা এবং সকোসোর সাথে নিয়মিত বৈঠক করে অগ্রগতি ফলো আপ করছেন দূতাবাসের সংশ্লিষ্টরা।
মালয়েশিয়ার সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বাংলাদেশে ওয়েজ অর্নার্স ওয়েল ফেয়ার বোর্ডের সহযোগিতায় বেনিফিট প্রদান করবে। গত ২৩ অক্টোবর প্রবাসী কল্যাণ বোর্ডের অতিরিক্ত সচিব মো. শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল মালয়েশিয়ার সোসকোর ডেপুটি চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ইনকিক জন রিবা অনাক মারিনের নেতৃত্বে সকসোর সংশ্লিষ্ট কর্মকতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন- ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ সচিব মো. আমিনুর রহমান, বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলার মো. জহিরুল ইসলাম, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রোগ্রামার পাপ্পু মজুমদার ও দূতাবাসের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার সিলভা।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিদেশি কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন বিধান চালু করার ঘোষণা দিয়েছিল দেশটির মন্ত্রিপরিষদ। ওই দিনই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন।
মানব সম্পদমন্ত্রী বলেছেন, মালয়েশিয়ার সামাজিক নিরাপত্তা সংস্থার (সকসোর) অধীনে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে কার্যকর হবে বলে জানিয়ে ছিলেন। সেই মোতাবেক কর্মরত বিদেশি কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন বিধানের আওতায় কোম্পানির মালিক পক্ষ তাদের বিদেশি কর্মীদের বীমার আওতায় নিবন্ধন শুরু করেছেন।
এর আগে সকসোর অধীনে শুধু স্থানীয় নাগরিকরাই এ সুবিধা পেতেন। মালয়েশিয়ার বিভিন্ন কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় পরিমাণ কমাতেই এ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এটি সফল বাস্তবায়ন হলে নিয়োগকর্তারা বিদেশি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও স্বচেষ্ট হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে কর্মী আজীবন পেনশন পাবে।
গত ১১ নভেম্বর কুয়ালালামপুরের ম্যাট্রেড কনভেনশন সেন্টারে (এমইসিসি) মাইসনারজি সিস্টেম সিনারজি এবং সিস্টেম লঞ্চ প্রোগ্রামে উপ-প্রধানমন্ত্রী ওয়াইবা দাতুক সেরি ডা, ওয়ান আজিজাহ ডা. ওয়ান ইসমাইল প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে (এমওসি) হস্তান্তর করেন।
২০২০ সালের বাজেটে বর্ণিত উদ্যোগগুলিকে স্বাগত জানিয়ে উপ প্রধানমন্ত্রী, ওয়াইবা দাতু সেরি ডা. ওয়ান আজিজাহ ডা. ওয়ান ইসমাইলও বলেন, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায কর্মীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা সংস্থা (এসওসিএসও) আর্থিক পরামর্শদাতা এজেন্সি (একেপিকে), গিয়াত মারা, মালয়েশিয়া (এআইএম) এবং মালয়েশিয়া ডিজিটাল কো-ওপারেশন (এমডিইসি) এর সহযোগিতায় সুবিধাভোগীদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও মান বাড়ানোর জন্য এই প্রোগ্রামটি চালু করা হয়।
এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দাতুক সেরি মোহাম্মদ আজমান আজিজ মোহাম্মদ বলেছেন, এই পদক্ষেপের ফলে সোকসো তাদের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমকে প্রসারিত করতে সক্ষম হবে।
মানবসম্পদমন্ত্রী এম কুলাসেগারান বলেন, বিদেশি কর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদের সকসোর সঙ্গে নিবন্ধন করতে হবে এবং কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা আইন ১৯৬৯ (অ্যাক্ট-৪) এর আওতায় আনতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, এতে কর্মসংস্থানে ক্ষতির পরিকল্পনার অধীনে চিকিৎসা সুবিধা, অস্থায়ী কর্ম অক্ষমতা সুবিধা, স্থায়ী অক্ষমতা সুবিধা এবং পুনর্বাসন সুবিধার পাশাপাশি প্রত্যাবাসন খরচের সুবিধা পাবে।