বছর শেষে কোম্পানি থেকে আড়াইশ ডলার বোনাস পেয়ে কী কিনবে তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে ছোট ভাই রবিন। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ভাই কী কেনা যায়? বললাম, বোনাসের টাকা দিয়ে ঘড়ি কেনো?
না ভাই আমার ভালো একজোড়া জুতা লাগবে। দেখেন দুই বছর আগে বাড়ি থেকে একজোড়া জুতা নিয়ে এসেছিলাম, আর কত বলুন? জুতারও একটা বয়স আছে? তার জুতার দিকে চেয়ে দেখলাম সত্যি জুতার অবস্থা খুবই খারাপ। সায় দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে জুতাই কেনো’।
না ভাই একটি প্যান্ট আর একটা জামা কিনি। আমার এই একটাই প্যান্ট আর জামাগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপর নিচে তার দিকে চোখ বুলিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে তাই কেনো’।
ছোট ভাই চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাতের মোবাইলটা দেখিয়ে বলল, ‘ভাই মোবাইলটা ভালো না, হ্যাং হয়ে যায়, কারো সাথে চ্যাট করতে পারি না। দুইশত ডলারে কী মোবাইল কেনা যাবে?
আমি তার এই সিদ্ধান্তহীনতা দেখে বুঝতে পারলাম, তার অনেক কিছুরই দরকার কিন্তু টাকা নেই। মাস শেষে সব টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে নিজের জন্য কিছুই কেনা হয় না। আমি এবারও সায় দিয়ে বললাম, ‘ঠিক আছে চলো মোবাইল কিনে দেই’।
ছোট ভাই কিছু না বলে ভাবনার জগতে হারিয়ে গেল, কী কেনা যায়। এবার গলার স্বর কিছুটা নিচু করে সে নিজের ঠোট কামড়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, আমার কিছু লাগবে না। টাকাটা বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব, মা কিছু কিনবে। আমি ছুটিতে দেশে গিয়েই কিনব। তার এই কথায় আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। তাকে বিদায় করে বাসায় চলে এলাম।
আমি নিশ্চিত সে আরও অনেকের কাছে পরামর্শ চাইবে কী কেনা যায়। এই পরামর্শ চাওয়া পর্যন্তই শেষ কিন্তু তার কিছুই কেনা হবে না। কারণ সে প্রবাসী তার চিন্তা নিজের জন্যই নয় পরিবারের সুখের জন্য। হয়ত কোনো এক সময় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবে আর তখনই সে পরিবার থেকে অবহেলা, ঘৃণা পেতে থাকবে। তাদের ভাবসাব এ রকম প্রবাসীরা নিজের ভবিষ্যৎ এর চিন্তা করতে পারবে না। চিন্তা করলেই পরিবার থেকে সে বঞ্চিত।
দুইদিন পর ছোট ভাইকে বিষণ্ন দেখে বুঝলাম তার উপর দিয়ে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে ছোট ভাই? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? ছোট ভাই বিষণ্নভাবে তাকিয়ে বলল, ‘ভাই আমার আড়াইশ ডলার মানিব্যাগ থেকে কে যেন নিয়ে গেছে।
নাইট শিফট করে বাসায় গিয়ে বিছানার এক পাশে মানিব্যাগ রেখে ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার ডলার নেই। রুমে তিনজন লোক ছিল এদের মধ্যে একজনকে সন্দেহ হয়। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ না থাকায় তাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। ‘ছোট ভাই আর কিছু বলতে পারল না, সে মনমরা হয়ে বসে রইল’।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি যে বললে টাকা বাড়ি পাঠাবে, তাহলে পাঠালে না কেন’? টাকাটা ব্যাংক থেকে তুলে বাড়িতে পাঠাতে চেয়েছিলাম কিন্তু মা বলল, ‘এই অল্প কয় টাকা না পাঠিয়ে মাস শেষে একসাথে পাঠিও, তাই পাঠানো হয়নি। নইলে টাকা ব্যাংকেই থাকত।
আমাদের কথার মাঝে একজন বলল, কৃপণের ধন পিঁপড়ায় খায়। তার কথা শুনে মেজাজটাই গরম হয়ে গেল। রাগান্বিতভাবে তাকে বললাম, ‘এই বয়সে সংসারের পুরো দায়িত্ব তোমার ঘাড়ের উপর পড়লে তুমিও বুঝতে কৃপণ কাকে বলে। এই ছেলেটার বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছে। এখন পুরো সংসারের দায়িত্ব তার উপর, তাই সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জীবন মানে কি?
আমার কথা শুনে সে চুপ হয়ে গেল। ছোট ভাইকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বলল, ‘যা হবার হয়ে গেছে, মন খারাপ করে থাকলে তো আর হারানো টাকা ফেরত আসবে না।
আর ভাই কষ্টার্জিত টাকা হারানোর যন্ত্রণা আমি জানি। তাই তো হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন, ‘মানুষের মূল্য খুবই সামান্য। দশ হাজার টাকা হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর পরেও সেই টাকার শোকে মানুষ কাতর হয়। কিন্তু মানুষ হারিয়ে গেলে কুড়ি বছর না কুড়ি দিন পরই আমরা মোটামুটিভাবে তাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করি’।
বি:দ্র: প্রবাসীদের উচিৎ ঘুমানোর আগে তার টাকা, মূল্যবান জিনিস লকারে তালাবদ্ধ করে রাখা। নিজেদের একটু সচেতনতাই পারে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে। আসুন সবাই সচেতন হই।
সিঙ্গাপুর থেকে ওমর ফারুক শিপন