প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপে স্থবির সারাবিশ্ব। এমন পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে প্রায় সব দেশের কল-কারখানা। কাজ না থাকায় ঘরেই বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত রেমিট্যান্সের ওপর।
মালয়েশিয়া থেকে প্রতিমাসে বৈধপথে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে যেখানে ১৫ থেকে ১৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স প্রবাসীরা দেশে পাঠাতেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত শুধু এনবি এল মানি ট্রান্সফার থেকে ২৯১,০৭, ৯৩,৮১৫ টাকা প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বর্তমানে চলমান লকডাউনের কারণে প্রবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়ায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রেমিট্যান্স কমে আসছে বলে জানান, এন বি এল মানি ট্রান্সফার মালয়েশিয়ার ইভিপি ও সিইও, শেখ আকতার উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, করোনার কারণে রেমিট্যান্স প্রেরণে যে ক্ষতিসাধন হয়েছে সেটি পুষিয়ে উঠতে কমপক্ষে ৬ মাস লাগবে। অগ্রণী রেমিট্যান্স হাইজের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ও ডিরেক্টর খালেদ মোর্শেদ রিজভী বলেন, মালয়েশিয়া প্রবাসীরা প্রথম আটমাসে ৮৭০ মিলিয়ন ডলার দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা গড়ে প্রতিমাসে ১০৯ মিলিয়ন ডলার পাঠাতেন প্রবাসীরা।
কিন্তু প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে মার্চ থেকে ৩০ শতাংশ নেমে এসেছে। মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নেগারার নির্দেশে লকডাউনের মধ্যেই ৪ মে সোমবার থেকে সবকটি রেমিট্যান্স হাউজ খুলে দেয়া হলেও প্রথমদিনে নেই কোনো প্রবাসী যে দেশে পাঠাবেন। করোনায় রেমিট্যান্স খাতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সেটা কাটিয়ে উঠতে কমপক্ষে আগামী তিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে বিপর্যয় পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কঠিন চ্যালেঞ্জে রয়েছে মালয়েশিয়া প্রবাসীরা। কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রবাসীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ঘরে বন্দি, দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। কাজ নেই, আয়ের পথও বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের খরচ মেটানোই দায় হয়ে পড়েছে। খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছেন তারা।
এ কষ্টের কথা বলতেও পারছেন না কাউকে। এছাড়া তাদের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে চলে দেশে থাকা পরিবার। প্রাণঘাতী করোনায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছে প্রবাসীদের আশা আকাঙ্খা। এ প্রাণঘাতী থেকে উওরণ কবে হবে কেউ জানে না। তবে সচেতনতাই এ মরণব্যাধি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে বলে বলছেন বিশিষ্টজনরা।
সিলেটের আবুল মিয়া, চার বছর ধরে মালয়েশিয়ায় থাকেন। একটি কন্সট্রাকশন সাইডে কাজ করেন। মার্চ থেকেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার সময় পার করছেন। ঘর থেকে বের হতে পারেন না। আগের কিছু পাওনা অর্থ মালিক দিয়েছিল, তা দিয়েই এ কয় দিন চলছে।
আবুল বলেন, দেশে পরিবার রয়েছে তাদের খরচ পাঠানো দরকার। কিন্তু কাজ বন্ধ দেশে টাকা পাঠাব কিভাবে? নিজেরই খাওয়ার খরচ নাই। বের হলে পুলিশ ঝামেলা করে। তাই বাইরে যাই না, ঘরেই থাকছি। খুব সমস্যায় আছি।
খোকন কাজ করেন কন্সট্রাকশনে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে ঘরে বসে আছি। আজ সোমবার থেকে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও কাজে যেতে পারছি না। কারণ আমার বৈধ কোনো কাগজ পত্র নেই। অমার মতো অনেকের কাজ নেই। খুব কষ্টে দিন পার করছি।
মালয়েশিয়া প্রবাসীরা বলছেন, রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ছিল। বর্তমানে টাকা পাঠানো প্রায় বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে থাকা প্রবাসী পরিবারে বিশেষ বরাদ্দ ঘোষণা দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রবাসীরা গত এপ্রিলে যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন তা বিগত ৩৭ মাসের মধ্যে (৩ বছরের বেশি) সবচেয়ে কম। করোনা সঙ্কটে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
গত বছরের এপ্রিলে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত বছরের একই মাসের চেয়ে এপ্রিলে রেমিট্যান্স আহরণ প্রায় সাড়ে ২৪ শতাংশ কমেছে। আগের মাস মার্চে রেমিট্যান্স আসে ১২৮ কোটি ৬০ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে রেমিট্যান্স কমেছে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ।
এদিকে ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং সর্বশেষ এপ্রিলে রেমিট্যান্স কমলেও অর্থবছরের দশমাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের দশ মাসে (জুলাই- এপ্রিল) রেমিট্যান্স এসেছে এক হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের একই সময়ে এক হাজার ৩৩০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। আলোচ্য সময়ে রেমিট্যান্স ১৫৭ কোটি ডলার বেড়েছে।