আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় হচ্ছে বাংলাদেশের দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেড বা ডিবিএল গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা। আগামী বছরের এপ্রিলে তাদের নিট পোশাক কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু হবে। সেই পোশাক রপ্তানি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে। জানা যায়, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার পাশের শহর মেকেলে ৭৫ হেক্টর জমির ওপর গড়ে উঠবে ডিবিএলের পোশাক কারখানা। ইতিমধ্যে প্রি-ফেব্রিকেটেড বা ইস্পাতের কাঠামোর কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে কারখানা নির্মাণ হয়ে যাবে। সেখানে সব মিলিয়ে ৪ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে। আগামী এপ্রিলে উৎপাদন শুরুর পর দ্বিতীয় বছরে গিয়ে কারখানাটি থেকে ৩ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৪০ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। পরের বছর পোশাক রপ্তানি ৪ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম আমাদের প্রথমে ইথিওপিয়া নিয়ে যায়। দেশটির সরকার প্রায় বিনা পয়সায় জমি দিচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের চেয়ে কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়। এমনকি বাংলাদেশের চেয়েও অর্ধেক বেতনে কারিগরি লোকজন মিলে। যেমন বাংলাদেশে কারখানার মহাব্যবস্থাপক নিয়োগ করতে মাসে দুই লাখ টাকা বেতন দিতে হয়, ইথিওপিয়ায় লাগবে এক লাখ টাকা।
ইথিওপিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রপ্তানিসুবিধা পাওয়া যাবে বলে মন্তব্য করেন এম এ রহিম। তিনি জানান, ইথিওপিয়া থেকেই কারখানার শ্রমিক নিয়োগ করা হবে। কারিগরি (টেকনিশিয়ান) লোকজন শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে আসবে। বিডিএল জানায়, ইথিওপিয়ায় পোশাক কারখানা স্থাপনের জন্য ৪ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করছে ডিবিএল। এর মধ্যে রপ্তানি প্রত্যাবাসন কোটার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৯৫ লাখ ডলার ইথিওপিয়ায় নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে তারা। নির্মাণকাজ শুরু করার জন্য ইতিমধ্যে ৩০ লাখ ডলার ছাড় করিয়ে ইথিওপিয়ায় নিয়েছে ডিবিএল।
এম এ রহিম বলেন, ইথিওপিয়ায় স্থাপিত কারখানা থেকে অর্জিত মুনাফার একটি অংশ দেশে আসবে। আরেকটি অংশ সেখানেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে। নিট কারখানার প্রকল্প সফল হলে পরবর্তী সময়ে সেখানে সুতা ও বস্ত্রকল করার ইচ্ছা আছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা পর্যায়ে একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।
এদিকে ইথিওপিয়ায় পোশাকসহ অন্য শিল্পকারখানা স্থাপনে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে দেশটির সরকার। দেশটির রাজধানী আদ্দিস আবাবার দক্ষিণে হুওয়াসা শহরে বস্ত্র ও পোশাকশিল্পের জন্য একটি শিল্পপার্ক সম্প্রতি উদ্বোধন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ৩০০ হেক্টর জমির ওপর ২৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই শিল্পপার্কে ৩৭টি পোশাক কারখানা হবে।
১৫টি কারখানা সেখানে উৎপাদনের জন্য প্রায় প্রস্তুত। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং ছয়টি স্থানীয় কোম্পানি আছে। এসব কারখানা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিভিএইচ করপোরেশন, কেলভিন ক্লেইন ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করবে। শিল্পপার্কের সব কারখানা পুরোদমে চালু হলে ৬০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বছরে রপ্তানির পরিমাণ হবে ১০০ কোটি ডলার।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বস্ত্র ও পোশাক খাতের অনলাইন পত্রিকা জাস্ট-স্টাইল সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে। এতে বলা হয়, ইথিওপিয়া থেকে ইতিমধ্যে এইচঅ্যান্ডএম, অ্যাসস, আসদার জেরোজি, প্রাইমার্ক, টেসকোর মতো পোশাকের বড় ক্রেতারা পণ্য আমদানি করে। তবে ব্যবস্থাপনা ও কারিগরি লোকের অভাব, বিদ্যুৎ-বিভ্রাট, দক্ষ লোকের অভাব ও বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা হওয়ার অজুহাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশটি থেকে পোশাক রপ্তানি এত দিন বৃদ্ধি পায়নি।
অবশ্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০১৪ সালে ইথিওপিয়া সরকার পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি শিল্পপার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করে। তাদের লক্ষ্যমাত্রা, আগামী ১০ বছরের মধ্যে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করা। প্রতিবছর দুই কোটি বর্গমিটার আয়তনের কারখানার স্থাপনকাজ শেষ করার পাশাপাশি পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া।
পিভিএইচ গ্রুপের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্ক গ্রিন জাস্ট-স্টাইলকে বলেন, ‘আমরা একটি ব্র্যান্ডকে নিয়ে ইথিওপিয়ায় গিয়েছি। সেখানে আমরা উন্নত মানের মিল ও পোশাক উৎপাদনের কারখানা করতে চাই।’ তিনি মনে করেন, ইথিওপিয়া বিশ্বের অন্য সব দেশের জন্য অনুকরণীয় হবে।
জানতে চাইলে ডিবিএলের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম বলেন, ‘পোশাক উৎপাদনে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা আছে। ফলে এখন দেশের বাইরে কারখানা করে মাল্টিন্যাশনাল (বহুজাতিক) কোম্পানি করার সময় এসেছে। ফলে যারা নৈতিক ব্যবসা করে ও যাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে, তাদের অনুমতি দেওয়া দরকার। তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যবসায়ীদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আছে বিভিন্ন দেশে। সেই বিনিয়োগ থেকে যে পরিমাণ মুনাফা ভারতে আসে, তা তাদের রপ্তানি আয়ের চেয়ে অনেক বেশি।
জানতে চাইলে ডিবিএলের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা থাকলে ক্রেতারা বেশি প্রাধান্য দেয়। ক্রেতাদের আস্থা বেশি থাকে। কারণ, তারা জানে, কোনো দেশে সমস্যা হলে অন্য দেশ থেকে তারা পণ্য পাবে। সে জন্য সরকারের উচিত দেখেশুনে এ ধরনের বিনিয়োগকে উৎসাহ দেওয়া। প্রথম আলো থেকে।