Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ধুঁকছে বিমান : লুটপাটেই শেষ অধিকাংশ আয়

bimanবিমানের আয়ের গুড় পিঁপড়ায় খায়। আয় যা হয় দেখানো হয় অনেক কম। ২০১৪ সালে প্রকৃত আয় ও প্রদর্শিত আয়ের বড় ফারাকের তথ্য তদন্ত প্রতিবেদনে ধরা পড়লে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। দুই বছর পর ২০১৬ সালে এসে তদন্তে নেমে দেখা যায়, পুকুরচুরি যথারীতি চলছেই। সঙ্গে নিয়োগ আছেই। প্রতিটি বিভাগেই ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে সরকারের বিপুল অর্থ। সিন্ডিকেটের সদস্যের রয়েছে রাজনৈতিক যোগসূত্র।

গ্রাউন্ড পাওয়ার ইউনিট (জিপিইউ) থেকে মাসে আয় ১৫ কোটি টাকা। দেখানো হচ্ছে আট কোটি টাকা। এয়ারকন্ডিশন ইউনিট থেকে ২৬ কোটি টাকার আয় হলেও কাগজে প্রদর্শিত হয় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। এয়ারবাসের টোবার থেকে এক কোটি টাকা আয় নথিপত্রে হয়ে যাচ্ছে ১৫ লাখ টাকা। কার্গো লোডার থেকে আয় হওয়ার কথা এক কোটি ২৫ লাখ টাকা, দেখানো হচ্ছে ৮০ লাখ টাকা। ট্রলিসেবার সাত কোটি টাকার আয় হয়ে যাচ্ছে সাড়ে চার কোটি টাকা। ২০১৪ সালে বিমানেরই তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির এ অবিশ্বাস্য চিত্র উঠে আসে। নিরপেক্ষ কোনো সংস্থাকে দিয়ে আরো গভীরে গিয়ে তদন্ত করে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছিলে সেই প্রতিবেদনে। তা মানা হয়নি। ২০১৬ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ নিজেরাই তদন্ত করে এবং কাছাকাছি চিত্র পায়। তবে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিন্ডিকেটের মূল হোতা বিমানের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের একজন সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর মেয়ের জামাতা।

chardike-ad

শাহজালালে প্রতিদিন গড়ে ১২০টি ফ্লাইট অবতরণ করে থাকে। তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের ১৫টি ফ্লাইট রয়েছে, বাকিগুলো দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসের। ৩০টির মতো কার্গো ফ্লাইটও ওঠানামা করে। একটি বিদেশি উড়োজাহাজে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সার্ভিস নিলে বিমানকে জিপিইউ বাবদ ভাড়া দেয়। এখান থেকে মাসে বিমান ১৫ কোটি টাকা আয় করলেও দেখানো হচ্ছে আট কোটি টাকা। এয়ারকন্ডিশন ইউনিট থেকে মাসে ২৫ কোটি টাকার স্থানে আয় দেখানো হয় ১০ কোটি টাকা। একইভাবে এয়ারক্রাফট পুশ টো-ট্রাক্টর থেকে পাঁচ কোটি টাকা আয় করে দেখানো হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা, মেইন ডেক কার্গো লোডার থেকে চার কোটি টাকার বদলে তিন কোটি, ওয়াটার সার্ভিস ট্রাক থেকে পাঁচ কোটি টাকার স্থলে তিন কোটি টাকা, ট্রলি সার্ভিস ট্রাক থেকে মাসে সাড়ে ছয় কোটির স্থানে চার কোটি, কনভেয়র বেল্টের ৮০ লাখ টাকার বদলে ৫০ লাখ, ফর্ক লিফট থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকার স্থানে আড়াই কোটি টাকা দেখানো হয়। এ ছাড়া যত খাত রয়েছে দুর্নীতি সর্বত্রই বিস্তৃত। বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সিন্ডিকেট নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করে। তাদের কাছে আমরা অসহায়। ’

জানা যায়, নিম্নমানের যন্ত্রপাতি আনা হয় বলে অনেক সময় কিছুদিনের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়ে। কয়েক বছর আগে বিদেশ থেকে তিনটি স্মার্ট কার্ড কেনা হয় পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার মার্কিন ডলারে। বছরখানেক পরেই নষ্ট হয়ে যায়। ৯৫ লাখ টাকায় কেনা দুটি এসিভ্যান কয়েক মাসের মাথায় বিগড়ে গিয়েছিল এবং ঠিক করার জন্য ২০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি আনা হলেও কাজ হয়নি। ৯ কোটি টাকায় কেনা চারটি সিপিএল মেশিন নষ্ট হওয়ার পর আর ভালো হয়নি।

বিমানের রুট না বাড়লেও, যাত্রীসংখ্যা কমলেও চলে লিজ বাণিজ্য। কিছুদিন আগে হঠাৎ আট মাসের জন্য এয়ারবাস লিজে নেয় চড়া দামে। এ উড়োজাহাজটি লিজে না নেওয়ার জন্য বিমানের বিভিন্ন শাখা থেকে প্রতিবাদ ও আপত্তি ছিল। পাইলটদের সংগঠনের পক্ষ থেকে চরম আপত্তি তোলা হলেও কাজ হয়নি। প্রতিবছরই হজের অজুহাতে শেষ মুহূর্তে চড়াদামে তাড়াহুড়া করে উড়োজাহাজ লিজে নেয় বিমান। এর সঙ্গে কমিশন বাণিজ্য চলার অভিযোগ রয়েছে। আগামী ২৪ জুলাই শুরু হওয়া হজের জন্য এবারও দুটি উড়োজাহাজ লিজে নেওয়ার দরপত্র আহ্বান করে। শেষ মুহূর্তে একটা ৭৭৭-২০০ ইআর পাওয়া যায়, যার লিজ দাম হচ্ছে প্রতি ঘণ্টা আট হাজার ৪০০ ডলার। এই উড়োজাহাজটি শুধু হজের জন্য কমপক্ষে ৭০০ ঘণ্টা সময়সীমার জন্য লিজে নেওয়া হয়েছে। অথচ ওই বিমানটি লিজ দাম ঘণ্টায় ছয় হাজার ডলারের বেশি হতে পারে না।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, কার স্বার্থে বিমান এত চড়াদামে রাজি হয়েছে তা রহস্যজনক। বিমানের এক কর্মকর্তা জানান, আগামী সপ্তাহেই মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে একটি প্রতিনিধিদল। আগামী মাসের মধ্যে সেটা বিমানবহরে যোগ হতে পারে। এর আগে গত ১০ এপ্রিল সংসদীয় কমিটি লিজ নেওয়া বিমান নিয়ে আপত্তি তোলে। লিজ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠায় সংসদীয় সাবকমিটিও গঠন করা হয়।

লুটপাটেই যত মনোযোগ, অবহেলিত যাত্রীসেবা। যাত্রীরা তাই বিমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ব্যাংকক থেকে দেশের অন্য দুটি বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস বাংলা ও রিজেন্ট যেখানে উড়োজাহাজ ভরে যাত্রী আনছে, সেখানে বিমান যাত্রী পাচ্ছে না। প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ৫০ জন যাত্রীও আসছে না। এর মধ্যে লন্ডনের ম্যানচেস্টার স্টেশন বন্ধ করে দেওয়ার গুঞ্জন আতঙ্ক ছড়িয়েছে। ম্যানচেস্টার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মনিরুল আমিন বুলবুল সম্প্রতি টেলিফোনে বলেন, প্রতি মাসে বিমান ২০ থেকে ২২ লাখ পাউন্ড আয় করছে। অথচ ওই স্টেশনটি বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে।

বিভিন্ন সূত্র মতে, বিমানে নিয়োগেই বেশি বাণিজ্য। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ইচ্ছামতো জনবল নিয়োগ দেয়। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটি প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন নেয় না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিধি-নিষেধও আমলে নেয় না। অপরিকল্পিত নিয়োগের কারণে অনেক বিভাগ জনবল যেমন পায় না, জনবল দরকার নেই এমন অনেক বিভাগে অতিরিক্ত জনবল অলস সময় পার করছে।

বিমানে বর্তমানে সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্টের ৪৯টি এবং শিডিউলিং রেকর্ড অ্যাসিস্ট্যান্টের দুটি পদে নিয়োগ চলছে। লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য নিয়ম অনুযায়ী সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মিলিটারি ইনস্টি্টিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিকে (এমআইএসটি) বিমান অনুরোধ করে গত ৬ মার্চ। প্রত্যাখ্যান করে এমআইএসটি বলেছে, অধীনস্থ কোনো সংস্থা অন্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাকে সরাসরি কোনো কিছু করার জন্য বলতে পারে না। যথাযথ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই অনুরোধ করা উচিত। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একটি অধীনস্থ সংস্থা হচ্ছে এই বিমান। আগেও মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে এমআইএসটিকে জনবল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অতীতে এ কারণে মন্ত্রণালয় বিমানকে সতর্কও করেছিল। এর পরও একই কাজ করার জন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইওকে কারণ দর্শানো হয়।

বিমানের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। অথচ ২০০৭ সালে বিমানকে কম্পানি করার সময় শর্ত দেওয়া হয়েছিল, এই কাঠামো করে অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। সেই থেকে বিমানের কাছে সাংগঠনিক কাঠামো চাচ্ছে বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় প্রতি মাসে সমন্বয় সভা করে। প্রতিটি সমন্বয় সভায় বিমানকে এই কাঠামো জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং প্রতিটি নির্দেশনাই বিমান এড়িয়ে যায়।

বিমানের একজন কর্মকর্তা জানান, এই কাঠামো বিমান অদ্যাবধি চূড়ান্ত করতে পারেনি। বিমানের সাবেক চেয়ারম্যান জামালউদ্দিনের আমলে কাঠামোর খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য একটি ভারতীয় কম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে সেই কম্পানি বিদায় নেয়। কিন্তু তা বিমান বোর্ডের পছন্দ হয়নি। তারা নিজেদের প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে একটি কাঠামো নিয়ে কাজ করছে। একবার তা অনুমোদিত হয়ে গেলে বিমান সহজে আর তা পরিবর্তন করতে পারবে না। এ কারণে বিমান তা মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠাচ্ছে না। আর সংগঠনিক কাঠামো একবার হয়ে গেলে বিমানের নিয়োগ বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যাবে, তাই এই কালক্ষেপণ।

সম্প্রতি বিমানে এমন সব পদে নিয়োগ হয়েছে যেগুলো পুরনো সাংগঠনিক কাঠামোতেও নেই—যেমন চিফ ফিন্যানশিয়াল অফিসার, ডিজিএম সিকিউরিটি, জিএম এসকিউ পদ! গত এপ্রিলে ম্যানেজার সিকিউরিটি পদে লোক নিয়োগ করে বিমান। নিয়োগে দেদার টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। বিমানের আট শাখায় অস্থায়ী পদে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ভয়াবহ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে জাল ও ভুয়া ডিও লেটার দিয়ে একটি চক্র নিয়োগ বাণিজ্য করছে। প্রতিটি নিয়োগে জনপ্রতি পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হচ্ছে। কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানের এক প্রভাবশালী জিএম, প্রশাসন, সিকিউরিটি, এমপ্লয়মেন্ট ও বিএফসিসি শাখার ১৫ জন এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর একটি সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।

বিমানে আইনি জটিলতা আরো আছে। বিমান পরিচালিত হচ্ছে ১৯৯৪ সালের কম্পানি আইনে। আর বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিচালিত হচ্ছেন ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ বিমান করপোরেশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ বিমান করপোরেশনকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস লিমিটেড নামে কম্পানিতে রূপান্তর করা হয়। এ পর্যন্ত বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি সংক্রান্ত কার্যক্রমের প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হয়নি। একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১০ বছর অতিক্রান্ত হলেও বিমানের চাকরি প্রবিধানমালা চূড়ান্ত না হওয়ার বিষয়ে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিমানকে লাভজনক করতে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রের এই সম্পদ কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। বিমানের যাত্রীসংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে যাতে বিমান ছেড়ে যায় সেই নির্দেশনা দেওয়া আছে। আন্তর্জাতিক রুটগুলোতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিমানে কোনো চোরের স্থান হবে না। তাদের প্রতিরোধ করা হবেই। কেউ অপতত্পরতা চালালে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, দুর্নীতি ঠেকাতে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রণালয়সহ সব কটি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাখা হয়েছে। শিগগির কমিটি একটি সুপারিশ পাঠাবে। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। রাষ্ট্রের সম্পদ কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের নজরদারি আছে।’ কালের কণ্ঠ