Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পাসপোর্টের ঘুষের ভাগ যাঁরা পান

আপনার পাসপোর্ট পেতে সময় লাগছে? দ্রুত পাসপোর্ট করতে চান? এসব কোনো সমস্যাই নয়। পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ে (ভেরিফিকেশন) হয়রানি কিংবা ফরম জমা দেওয়ার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর ভোগান্তিও পোহাতে হবে না। এ জন্য আপনাকে যেতে হবে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু নারী-পুরুষের কাছে। তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন অনায়াসে।

সাধারণ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এরা ‘পাসপোর্ট অফিসের দালাল’ নামেই পরিচিত। তবে আজকাল পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে-বাইরে ‘দালাল’ শব্দটি এমনভাবে উচ্চারিত হয়, যেন এঁরা সেখানে চাকরি করেন। চাকরি না করলেও এই দালালেরা কাজ করেন মূলত পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে। কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ছাড়া দালাল নামের এসব ‘হিরো’দের ক্ষমতা একেবারেই ‘জিরো’।

chardike-ad

সম্প্রতি অনুসন্ধান ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে পাসপোর্ট অফিসের এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, এই বাণিজ্যের সঙ্গে কেবল পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তা আর দালাল জড়িত, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। এর সঙ্গে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী (পুলিশ, এসবি, র‍্যাব) বাহিনীর কিছু সদস্য, পাসপোর্ট অফিসের সামনে দায়িত্বরত আনসার সদস্য, আগারগাঁও এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা এবং শেরেবাংলা নগর থানাসহ বিভিন্ন পক্ষ জড়িত। সব পক্ষ মিলেই গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চক্র। এই চক্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন পরিচালক এবং দুজন উপসহকারী পরিচালকের সরাসরি যোগসূত্র আছে বলে ওই গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

গোয়েন্দা সংস্থাটি সম্প্রতি আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসের এই চক্র নিয়ে অনুসন্ধান চালায়। তদন্তের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একজন পরিচালক এ প্রতিবেদন এবং প্রমাণ হিসেবে কাগজপত্র ও ভিডিও ফুটেজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব বরাবর পাঠিয়েছেন।

passport-bribeগোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন অনুযায়ী দালালের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান পেতে হলে একজন গ্রাহককে গুনতে হয় অন্তত নয় হাজার টাকা। দর-কষাকষিতে ক্ষেত্রবিশেষ তা আট হাজারে নামতে পারে। তবে সেই সংখ্যাটা কম। অথচ বৈধ উপায়ে একজন গ্রাহকের পাসপোর্ট করতে সরকার-নির্ধারিত খরচ ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে একজন গ্রাহককে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৫৫০ টাকা। এই টাকা পায় পাঁচটি পক্ষ। কে কত টাকা পাবেন, তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করা। ফলে ভাগাভাগি নিয়ে পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সংঘাত বা অন্তঃকোন্দল দেখা যায় না। কখনো কখনো দালালেরা গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এমন ঘটনা বা নজিরও আছে।

সরেজমিন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস: তিন দিন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ঘুরে এবং দালাল ও অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে গ্রাহক পরিচয়ে কথা বলে, আবার কখনো সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলে দালালদের দৌরাত্ম্য এবং তাঁরা কীভাবে কাজ করেন, সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, একজন দালালকে অর্ধেক টাকা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর গ্রাহকের আর ভোগান্তি থাকছে না। প্রতিটি গ্রাহকের ফাইল প্রস্তুত করা, ফরম সত্যায়িত করা, ফরম জমা দেওয়া এবং পুলিশি যাচাই-বাছাই শেষে গ্রাহকের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজই দালাল করে দিচ্ছেন।

সেখানেই দেখা হয় মো. সহেলের সঙ্গে। এভাবে পাসপোর্ট করতে কোনো ঝামেলা হবে কি না, জানতে চাইলে তাঁর ঝটপট জবাব, ‘এটা নিয়ে আপনার চিন্তার কারণ নেই। আপনি আমাকে ঠিক ইনফরমেশন দেবেন। বাকি দায়িত্ব আমার। তবে যে ইনফরমেশন দিচ্ছেন, সেখানে ভুল বা ঘাপলা থাকলে এবং আমার কাছ থেকে লুকানো হলে আমার দায় নেই।’ টাকা নিয়ে আপনি যদি লাপাত্তা হন, তখন কী হবে? সহেলের উত্তর, ‘এখানে আমাকে সবাই চেনে, বহু বছর ধরে কাজ করছি। এমন ঘটনা নেই।’ তিনি বলেন, অনেকে দালাল চিনতে ভুল করেন বলে প্রতারিত হন।

যেভাবে কাজ করে দালাল চক্র: আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ পর্যন্ত পাসপোর্ট তৈরি হয়। এর মধ্যে ১৫০ থেকে ২০০ পাসপোর্ট আবেদন দালালদের মাধ্যমে জমা হয়। দালালদের মধ্যে ১৪ জন বেশ শক্তিশালী। এর বাইরে আরও প্রায় অর্ধশত দালাল আছেন। এঁরা গ্রাহক সংগ্রহ করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা ও কাগজপত্র নেন। এরপর ভুয়া সত্যায়ন করে ফরম জমা দিয়ে দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দালালদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনজন। এঁরা হলেন শহিদুল ইসলাম, আকরাম হোসেন ও রেজাউল নামে আনসারের এক সদস্য।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দালালেরা পাসপোর্ট অফিসের ৭০১ ও ৭০২ নম্বর কক্ষে ডিএডি আমিন ও ইয়াসিনের কাছে পৌঁছে দেন এবং একই সঙ্গে তাঁদের হাতে পাসপোর্টপ্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা তুলে দেন। এই দুই কর্মকর্তা তখন প্রতি পাসপোর্টের ফরমের ওপর একটি বিশেষ সই দেন। এই সইয়ের কারণে নির্দিষ্ট ফরম দ্রুত এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ছুটতে শুরু করে। সই করার পর আমিন ও ইয়াসিন পরিচালক এ টি এম আবু আসাদের কাছে ঘুষের টাকা জমা দেন। এরপর সেই টাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ হয়। সরেজমিনেও একই চিত্র পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে এ টি এম আবু আসাদের দপ্তরে গেলে তাঁর একজন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান তিনি মিটিংয়ে আছেন। এরপর টেলিফোনে কথা বলতে আসাদের ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হয়। পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতির ঘুষ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর নামও রয়েছে—গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা কোনো উত্তর না দিয়ে প্রতিবেদককে তাঁর অফিসে এসে চা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানান।

দালালেরা ছাড়পত্রের জন্য গ্রাহকের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানার পুলিশের অফিসে এক হাজার করে দুই হাজার টাকা পৌঁছে দেন। বড় ধরনের সমস্যা না থাকলে পুলিশ কোনো তদন্ত ছাড়াই ছাড়পত্র দিয়ে দেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দালালেরা স্থানীয় প্রভাবশালীদের জন্য পাসপোর্টপ্রতি ২০০ টাকা দেন। মো. জাকির হোসেন নামে (শহিদুল নামে পরিচিত) এক ব্যক্তি এই টাকা নেন। এ ছাড়া স্থানীয় শেরেবাংলা নগর থানার জন্য ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। থানা-পুলিশের পেট্রল ডিউটির সময় যেন দালালেরা ধরা না পড়েন, সে জন্য এই টাকা দেওয়া হয়।

একজন দালাল কত পান?: সঠিক লোক ধরা থেকে সব কাজই করেন একজন দালাল। সব কাজ শেষ করে প্রতি পাসপোর্টে একজন দালাল পান ১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ২ হাজার ২৫০ টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে বেশি নিতে পারলে তাঁর লাভটা বেশি। কম নিলে লাভের অঙ্ক কমে যায় তাঁর। তবে বাকি ঘুষের ক্ষেত্রে কোনো নড়চড় হয় না। এগুলো সুনির্দিষ্ট। অর্থাৎ গ্রাহকের দেওয়া টাকার ৩ হাজার ৪৫০টাকা সরকার-নির্ধারিত ফি। পুলিশি যাচাইয়ে দুই হাজার টাকা। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা পান এক হাজার টাকা। আর স্থানীয় প্রভাবশালী ২০০ টাকা এবং স্থানীয় থানার জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকা। সত্যায়িতসহ আনুষঙ্গিক খরচ আরও ৫০ টাকা। এই ৬ হাজার ৭৫০ টাকার পর যেটা উদ্বৃত্ত থাকে, সেটাই একজন দালালের আয়। যদি গ্রাহকের কাছ থেকে দালাল আট হাজার টাকা নেন, তাহলে তাঁর লাভ থাকে ১ হাজার ২০০ টাকা। আর নয় হাজার টাকা নিতে পারলে লাভ থাকে ২ হাজার ২০০ টাকা।

বাবুল হাওলাদার ও মরিয়ম নামের দুই দালাল বললেন, অনেক সময় মানুষের জরুরি পাসপোর্ট লাগে। তখন টাকা বেশি পাওয়া যায়। তখন তাঁদের লাভটাও বেশি থাকে।

সূত্র: প্রথম আলো