Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ট্রাম্পের তিন মুসলিম বিদ্বেষী টুইটের নেপথ্যে

trumpবুধবার ভোরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প তার টুইটার অ্যাকাউন্টে তিনটি ভিডিও ‘রি-টুইট’ করেন। তিনটি পোস্টেই মুসলিমদের নেতিবাচকভাবে দেখানো হয়েছে। এই কান্ডের পর বিশ্বব্যাপী ফের কড়া ভাষায় তার নিন্দা জানানো হয়। এই তিনটি ভিডিও ধারণ করা হয়েছে পৃথক তিনটি দেশে। ধারনের সময়কালও ভিন্ন। তিনটিরই অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে মুসলিমদের হাতে সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে বলে দেখানো হচ্ছে।

কিন্তু ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপট খুবই আলাদা।
প্রথমে এই ভিডিও তিনটি টুইট করেছিলেন বৃটেন ফার্স্ট নামে যুক্তরাজ্যের একটি উগ্র-ডানপন্থী গোষ্ঠীর নেতা জেইডা ফ্রান্সেন। সেগুলোই রি-টুইট করেন ট্রাম্প। দেখা যাক ভিডিও তিনটির মজেজা।
প্রথম ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ডাচ কিশোরকে পেটাচ্ছে মুসলিম অভিবাসী।’ এই ভিডিওতে এক কিশোর আরেক কিশোরকে পেটাচ্ছে এমনটা দেখা যাচ্ছে। টুইটে বলা হচ্ছে, যে পেটাচ্ছে, সে একজন মুসলিম অভিবাসী। কিন্তু নেদারল্যান্ডের সরকারী কর্মকর্তারা বলছেন, ভিডিও’র উভয় কিশোরই ডাচ নাগরিক। এদের কেউই অভিবাসী নয়। দেশের নর্থ হল্যান্ড প্রদেশের ছোটো শহর মনিকেনড্যামে মে মাসে ভিডিওটি ধারণ করা হয়। প্রদেশটির সরকারী কৌঁসুলির কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, হামলাকারী কিশোরের বয়স ১৬ বছর। তার জন্ম ও বেড়ে উঠা নেদারল্যান্ডে। এই ভিডিওটি প্রকাশের পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কার্যালয়ের প্রেস কর্মকর্তা মারলিন ভ্যান ফেসেন জানান, হামলাকারীকে কিশোর অপরাধী হিসেবে সাজা দেওয়া হয়েছে।
ভিডিওতে দুই কিশোরের ধর্মপরিচয় সম্পর্কে কোনো প্রমাণ নেই। উভয়েই ডাচ ভাষায় কথা বলছিল। কিন্তু কেন হামলাকারীকে মুসলিম বলা হচ্ছিল, সেটি পরিষ্কার নয়। বুধবার ডনাল্ড ট্রাম্পের টুইটের পর, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত নেদারল্যান্ডের দূতাবাস টুইট করে পুরো ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে।
ট্রাম্পের রি-টুইট করা দ্বিতীয় ভিডিওটির শিরোনাম ছিল: যীশুর মা মেরির মূর্তি ভাঙ্গছে এক মুসলিম। কিন্তু সত্য হলো, ভিডিওর ওই লোকটি সাধারণ কোনো মুসলিম ছিলেন না, তিনি ছিলেন সিরিয়ার একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য। আবো ওমর ঘাবরা নামে ওই ব্যাক্তি ভিডিও ধারণের সময় জঙ্গিগোষ্ঠী জাবেত আল-নুসরা বা নুসরা ফ্রন্টের (আল কায়দার শাখা) সদস্য ছিলেন। কিন্তু ভিডিওর শিরোনামে তাকে শুধু ‘মুসলিম’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।
অন্য ধর্মের পবিত্র স্থাপনা বা মূর্তি জঙ্গিরা যখনই ধ্বংস করেছে, বৃহত্তর মুসলিম সমাজ তার নিন্দা জানিয়েছে। তাই কনটেক্সট বিহীন বা পূর্বাপর প্রসঙ্গ উল্লেখ ব্যতিরেকে এই টুইটটি যথার্থ ছিল না।
২০১৩ সালে সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের কুনায়া গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছিল। নাজির আবদো নামে এক ব্যক্তি ওই সময় একই গ্রামে বাস করতেন। তিনি সিরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনাগুলো নথিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত গণমাধ্যম কর্মী। নাজির বলেন, আবো ওমর ঘাবরা নামে ভিডিওর ওই ব্যক্তি পরে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এ যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু আইএস’র রাজধানী রাক্কা মার্কিন সমর্থিত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসার পর তিনি পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আলেপ্পোতে সিরিয়ান বিদ্রোহীরা তাকে আটক করে।
২০১৩ সালে ঘাবরার ওই ভিডিও বিভিন্ন গ্রুপ ব্যপকভাবে শেয়ার করে। বিশেষ করে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আল আলম ও আমেরিকার ষড়যন্ত্র তাত্বিক অ্যালেক্স জোন্সের ইনফোওয়ার্স ওয়েবসাইটও এই ভিডিও প্রকাশ করে। এত বছর পরও, উগ্র ডানপন্থী, মুসলিম-বিদ্বেষী ও মার্কিন রক্ষণশীল ঘরানার মিডিয়ায় এই ভিডিও’র আবেদন এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
ট্রাম্পের রি-টুইট করা তৃতীয় ও সর্বশেষ ভিডিওর শিরোনাম ছিল: ‘কিশোরকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে ইসলামিস্টরা।’ এই ভিডিওটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ধারণ করা হয়েছে মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ার সিদি গাবের এলাকা থেকে। এটি মূলত উৎখাতকৃত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির সমর্থক ও প্রতিপক্ষদের মধ্যে একটি সংঘাতের ভিডিও ফুটেজ। এই তথ্য টুইটে দেওয়া হয়নি। মিশরে তখনকার জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও কোনো বর্ণনা এতে ছিল না।

chardike-ad

মিশরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সামরিক বাহিনী উৎখাত করার কয়েকদিন পরই ঘটনাটি ঘটে। তখন দেশজুড়ে সর্বত্র অস্থিরতা বিরাজ করছে। মুরসিকে উৎখাতের পর দেশটিতে তার সমর্থক, বিরোধী ও পুলিশের মধ্যে অনেক সহিংসতা ঘটে। দেশটির পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল যে, ২০১৩ সালের আগস্টে এক দিনে কায়রোয় সামরিক বাহিনীর হাতে ৮০০ জন প্রতিবাদকারীও নিহত হয়েছিল।
ভিডিওতে এক হামলাকারীকে দেখা যায় কালো পতাকা হাতে। তখন এটি বিভিন্ন ইসলামি গ্রুপই ব্যবহার করতো। তখনও জঙ্গিগোষ্ঠি আইএস’র পতাকা হিসেবে কালো পতাকা পরিচিত হয়ে উঠেনি। কালো পতাকা হাতে ওই ভিডিওতে যে ব্যাক্তিটি ছিলেন, তার নাম মাহমুদ রমাদান। তাকে এক কিশোরকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ২০১৫ সালের মার্চে তাকে ফাঁসিও দেওয়া হয়। ছাদে যেই কিশোরদের দেখা গিয়েছিল তারা সামরিক বাহিনী-বিরোধী একটি সভায় পাথর মেরেছিল বলে ভেবেছিল ওই লোকেরা। এ কারণেই হয়তো তাদের ওপর ওই আক্রমণ করা হতে পারে বলে জানায় মিশরের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
ভিডিওটি নিঃসন্দেহে সহিংস ঘটনা। কিন্তু তখনকার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ না করে ভিডিওতে ইসলামিস্ট হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয় হামলাকারীদের।