গেট পার হয়ে ১০ গজ ভিতরে গিয়েই পড়লাম বাঘের মুখে, ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’। একটা নয় একসাথে দুটো, গা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে একটা ডিবির উপর, গরমে ক্লান্ত মনে হয়! ‘ড্রাইভার’ গাড়ি নিয়ে পাশে দাঁড় করানোর পর একবার মাথা তুলে তাকালো মাত্র, যাক এ যাত্রা বাঁচা গেল মনে হয়। কিন্তু একি!
আরেকটা এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে গাড়ির সামনে! একবার কাঁচের গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো নিজের জায়গায়।
গাড়ির কাঁচ পরীক্ষা করে নিলাম একবার, না বিশেষভাবে তৈরী এই গাড়ির খাঁচায় আমরা নিরাপদ, আমাদের ‘ড্রাইভার’ অনেক কসরত করে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুনোর পর দেখলাম আরো কয়েকটা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বাধীন, এদিক ওদিক। বিশেষভাবে বাঘের আকারের তৈরী গাড়ি এগুচ্ছে আমাদের নিয়ে, ধীরে ধীরে, সাবধানে, শব্দবিহীন। ‘ড্রাইভার’রাও বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত। চিড়িয়াখানা আর ‘সাফারী পার্কে’র পার্থক্যটা এখানেই, চিড়িয়াখানায় পশু-পাখি থাকে খাঁচাবন্দী, আর আপনি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবেন, বন্য পশুদের খোঁচাখোচি করে আদিপিতা বানরকেও হার মানানোর চেষ্টা করবেন আর ‘সাফারী পার্কে’ পশুরা ঘুরে বেড়াবে স্বাধীন, আপনাকে ঘুরে বেড়াতে হবে খাঁচাবন্দী হয়ে। ভূমিকা ছাড়াই শুরু করে দিলাম, আমরা ঘুরতে এসেছি ‘স্যামসাং গ্রুপ’ এর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান ‘এভারল্যান্ড’ এর ‘সাফারী পার্কে’, এরপর একে একে ঘুরতে যাবো ‘ডিজনী ল্যান্ড’ এর আদলে গড়া ‘ইয়ংইন’ শহরের ‘এভারল্যান্ড’ এবং ‘ক্যারিবিয়ান বে’ শহরের কিছু অংশে।
এখানে ‘স্যামসাং’ সম্পর্কে চমকপ্রদ এবং অনেকের অজানা কিছু কথা বলে নেই! ১৯৩৮ সালে লি বিয়ং জুল পরিবার যখন ‘দেগু’ শহরে এসে প্রথম ‘স্যামসাং’ এর শুটকি ও সবজির ব্যবসা শুরু করেন তখনকার কোরিয়ার চেহারা দেখলে আঁৎকে উঠবেন নির্ঘাত! মনে হতে পারে ৪০০ বছর আগের আমার ঢাকা ছিল পৃথিবীর আধুনিকতম উন্নত শহরগুলোর একটা। আর ১৯৩৮ এর দেশবিভাগের ক্রান্তিকালে আমরা বাস করছিলাম পৃথিবীর স্বর্গে। ‘স্যামসাং’ এর ‘ইলেকট্রনিক্স’ শাখা এখন পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয়। ২০০৮ এর অর্থনৈতিক মন্দাকালে এই গ্রুপের ১৭৩ বিলিয়ন ডলারের (শুধুমাত্র কোরিয়ার আভ্যন্তরীন) আয় ছিল পৃথিবীর তাবৎ দেশ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের ‘রেঙ্কিং’ এ ৩৫তম, যা কিনা আর্জেন্টিনার মত দেশের জি ডি পি’র চাইতেও বেশি। একজন ব্যক্তির একক উদ্যোগ কি করে পুরো দেশের অর্থনীতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে তা দেখতে হলে দেখতে হবে ‘স্যামসাং। অথচ এইতো ১৯৮০ তে ওরা প্রথম সাদাকালো টিভি তৈরী করে যাত্রা শুরু করেছিল ‘ইলেকট্রনিক্স’ এর! এরপর আর পিছন ঘুরে তাকাতে হয় নি। ‘৬০/৭০’ এর দশকের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট পার্ক এর বিদেশী পণ্য দেশে ঢুকতে না দেয়ার রক্ষনশীল নীতিমালা নিঃসন্দেহে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে ‘স্যামসাং’কে, একই সাথে দেশের অপরাপর ‘ইন্ডাস্ট্রি’কেও। একক প্রতিষ্ঠান হিসেবের কোরিয়ার সর্বমোট রপ্তানীর ২০ ভাগ হলো ‘স্যামসাং’-এর, এটাও সম্ভবত পৃথিবী শীর্ষ; এমনি করে ‘স্যামসাং’ এর শীর্ষত্বে’র হিসাব দিয়ে আসলে শেষ করা যাবে না। কি নেই ওদের! ‘লাইফ ইন্সুরেন্স’ থেকে শুরু করে ‘শিপিং’, ‘এরোস্পেস’ থেকে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’, ‘রিসার্স এন্ড ডেভেলপমেন্ট’! মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ার থেকে শুরু করে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা ‘বার্জ খলিফা’ তৈরী করেছে ‘স্যামসাং কন্সট্রাকশন’ই। যাই হোক এ নিয়ে বিস্তারিত অন্য কোনো সময় বলা যাবে।
শুরু করেছিলাম ‘স্যামসাং গ্রুপ’ এর ‘সাফারী পার্ক’ থেকে, আবার ফিরে যাই সেখানে। ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ এর বিশালাকার রাজত্ব থেকে বের হয়ে আমরা খাঁচাবন্দী হয়ে একে একে পাড়ি দিলাম শাদা রঙ এর ‘সাইবেরিয়ান টাইগার’, জেব্রা, সিংহ, হাতি, জিরাফ, ‘লাইগার’ সহ আরও নানা পশুর রাজত্ব, বের হওয়ার পথে দেখা হলো ভাল্লুক মামাদের সাথে, এদের মধ্যে দু’টার আবার আমাদের ‘ড্রাইভার’ এর সাথে চমৎকার সৌহার্দ্য। ‘ড্রাইভার’ উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে, হাততালি দেয়, ‘চিপস’ ছুড়ে দিলে ‘চিপ্স’ মুখে নিয়ে কোরিয়ান ভঙ্গীতে সম্ভাষন জানায়। বিষ্ময় চুরান্তে উঠলো সাফারী পার্ক থেকে বের হয়ে এভারল্যান্ডে যখন পশুপাখিদের মঞ্চনাটক দেখতে গেলাম, প্রথমে ‘সী লায়ন’, ‘সী লায়নের বুদ্ধিমাত্রার কথা আগেও শুনেছি কিন্তু নির্দেশনা অনুসারে নানা রকম শারিরীক কসরত এর পাশাপাশি এরা যে অভিনয়ও করতে পারে এটা আমার জানা ছিল না! তিনটে বড় ‘সী লায়ন’ এর সাথে নাটকে জুটি বেধেছে একটি বাচ্চা ‘সী লায়ন’, তিনজন প্রশিক্ষক এবং একটি রাজহাঁস, এরপর আরো একটি শো-তে দেখা গেল কুকুর থেকে শুরু করে বানর, বাঘ, ইদুর, নানা রকম পাখি এমনকি মুরগীর নানা রকম কসরত। একটা কাকাতুয়াকে দেখা গেল একজন দর্শকের উঁচু করে ধরা হাত থেকে টাকা ছিনিয়ে নিতে আবার ফিরিয়ে দিতেও, মজাটা এখানে নয় মজাটা হলো যখন সে এক হাজার কোরিয়ান ওন ফেরত দিল কিন্তু ১০ হাজারটা দিল না!
‘এভারল্যান্ড’ মূলত ‘এমিউজমেন্ট পার্ক’, বাচ্চাদের জায়গা বলে শুরু থেকেই আমার কিছুটা অনিহা ছিল এই জায়গার প্রতি, কিন্তু এটা যে বড়দেরও বিনোদন এর জায়গা হতে পারে তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। কি নেই এখানে! ডিজনীল্যান্ড এর আদলে আস্ত এক বিনোদোন নগরী গড়ে তুলেছে স্যামসাং। উচ্চতা ভীতি আছে বলে কয়েকটা ‘রাইড’ আমি বাদ দিয়ে গেলাম, এদের আবার রেকর্ডের খাতা, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ভয়ংকর, এমন নানারকম তকমা!
T Express নামের পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া অর্থাৎ ৭৭ ডিগ্রি ‘উডেন রোলারকোষ্টার’ এ তিন মিনিট ধরে যন্ত্রনা ভোগ করে এসে আমাদের এক ভ্রমণ সঙ্গীনী বলছিল-“কারো যদি জীবনের প্রতি চূড়ান্তরকম অনীহা চলে আসে তাহলে তাকে একবার এই রোলার কোস্টারে উঠিয়ে দেয়া উচিত, নেমে আসার পর যাই দেখবে, যাই করবে, ভালো লাগতে শুরু করবে!” এর ঠিক আগেই ‘ডাবল’ ৩৬০ ডিগ্রির চক্করঅলা এক রোলার কোস্টার থেকে ঝাঁকি খেয়ে এসে এটার উচ্চতা আর কাঠের কাঠামো দেখে আমি আর সাহস করিনি চড়তে, নিজেকে সান্তনা দিলাম এই বলে যে, না আমার জীবনের প্রতি কোনো অনীহা নেই, আমি জীবন ভালোবাসি। এখানে এসে লাভ হলো এত ধরনের পশুপাখি একসাথে এমন আমুদে পরিবেশে আমি আর জীবনে দেখিনি। বড্ড মায়া হলো আমাদের মিরপুরের খাচায়বন্দী পশুপাখিদের জন্য। ‘সাফারী পার্ক’ এবং ‘এভারল্যান্ড’ এর নানারকম ‘শো’ এবং রাইড দেখতে দেখতে প্রথম দিন কেটে গেল, মূল শহর থেকে অনেক দূরে গড়ে তোলা এই বিনোদোন শহর, আমাদের যেতে হবে হোটেলে ‘এভারল্যান্ড’ এর গাড়িতে করেই। তাঁর আগে রাতের খাবার সেরে নেয়া। ‘সাম গে থান’ নামের এক সিদ্ধ মুরগী ট্রেডিশনাল খাবার দিয়ে ‘ডিনার’ করলাম। দিন কয়েক আগেই ছিল এই খাবার এর বিশেষ উৎসব। মুরগীর পেটের মধ্যে চাল, শুকনো বড়ই এবং ‘জিনসেং’ দিয়ে গরম পানিতে সেদ্ধ করা এই খাবারটি প্রথমবার খেতে গেলে দুনিয়ার কারোরই ভালো লাগবে না এটা নিশ্চিত, রক্তমাখা কাচা মাংশের দলার সামুদ্রিক ‘স্কোয়ার্ট’ একবার গেলার পর এখন অবশ্য আমি এখন কোরিয়ান সব খাবারই খেতে পারি। কিছু খাবার ভালোও লাগে।
পরদিন সকালে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় (কৃত্রিম) ওয়াটার ওয়ার্ল্ড ‘ক্যারিবিয়ান বে’ তে। এরও আছে রেকর্ডের ছড়াছড়ি, সবচেয়ে বড় কৃত্রিম বীচ, ঢেউ, নানারকম রাইড (বেশিরভাগই আবার বাচ্চাদের জন্য নিষিদ্ধ), ‘সার্ফিং’ এর ব্যবস্থা, কৃত্রিম নদী, ‘ওয়াটার ম্যাসাজ’ সহ আরো নানা কিছু। পানির প্রতি বিশেষ মমত্ব থাকার কারণে দিনটা ভালোই কাটলো। তাছাড়া অনেকদিন পর সাঁতার কাটার সুযোগ পেলাম!
পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় রাত কাটাতে গেলাম আমরা একটা চমৎকার হোটেলে, সম্পূর্ণ কাঠের তৈরী ছোট আস্ত একটা বাড়ি দেয়া হলো আমাদের চারজনকে। রাতে বারবিকিউ পার্টি করার ব্যবস্থা আছে এটাই ছিল আমাদের পছন্দের মূল কারণ। ছোট ছোট এমন আরো কিছু হোটেল বাড়ি আমাদের পাশাপাশি, আমাদের পাশের বাড়িতে এসে উঠলেন ছোট দুটি বাচ্চাসহ এক কোরিয়ান পরিবার। আমাদের সামনেই বেশ নাখোশ হতে দেখলাম তাদেরকে যখন তাদের জানানো হলো যে হোটেল মালিক বারবিকিউ করার সব উপকরণই দেয় মাংশ ছাড়া। ভদ্রলোক মাংশ নিয়ে আসেন নি, হোটেলগুলো আবার শহর থেকে অনেক দূরে, এত রাতে মাংশ পাওয়া যাবে এমন কোনো দোকান নেই। আমরা আগেই জানতাম। রাতে বারান্দায় বসে বারবিকিউ করার সময় ওদের বারান্দায় ওরা যখন শুকনো কোনো খাবার চিবুচ্ছিল বাচ্চাগুলোর জন্য মায়াই হলো! আহারে! বছরে একবার হয়তো সুযোগ পায় এমন কোথাও ঘুরতে আসার। আমি একটা প্লেটে কিছু পোড়ানো মাংশ নিয়ে গেলাম, ওরা এত খুশি হলো যে ভাবনার অতীত। একটু পর দেখি ভদ্রলোক এবং বাচ্চাদুটো আমাদের জন্য ঐ প্লেটে করে চারটে আইসক্রিম নিয়ে এসেছে, বললো “আমাদের আর কিছু নেই এখন তোমাদের দেয়ার মতো, কি করে যে ধন্যবাদ জানাবো!”। ভালো লাগলো।