Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

আজ ঐতিহাসিক খোয়াংজু বিপ্লবের ৩৮ বছর

খোয়াংজু শহরে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সমাবেশ

খোয়াংজু। দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমের একটি শহর। আভিধানিক অর্থে খোয়াংজু শব্দের অর্থ হচ্ছে আলোর শহর (city of light)। এটি দক্ষিণ কোরিয়ার ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর। খোয়াংজু শহরের নাম আসলেই ভেসে উঠে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথা, যেমন ১৯২৯ সালে জাপানিজদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ, ১৯৮০ সালের ১৮ই মে বিদ্রোহ ইত্যাদি। পরাধীন থাকা অবস্থায় ১৯২৯ সালে জাপানিজদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যেমন এই শহরের আপামর ছাত্রজনতা প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল ঠিক তেমনি স্বাধিনতার পরেও ১৯৮০ সালে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল এই এই শহরের আপামর ছাত্রজনতা। যা পরবর্তীতে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়লে সেটি একটি গনতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিনত হয় এবং  পিছু হটতে বাধ্য হয় তৎকালিন স্বৈরশাসকের অনুগত সেনাবাহিনী, স্বৈসশাসনের অবসান ঘটে গনতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা ফিরে আসে দক্ষিণ কোরিয়াতে। আধুনিক দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে একটি দুঃখজনক ও ন্যাক্কারজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে সেই গনতান্ত্রিক বিপ্লব। আজ ১৮ই মে ২০১৭ পালিত হচ্ছে সেই গনতান্ত্রিক বিপ্লবের ৩৮ বছর পূর্তী। দিবসটি নিয়ে তার ইতিবৃত্ত, ঘটনা প্রবাহ আলোচনা করছি।

কী ঘটেছিল ১৯৮০ সালের ১৮ই মে

chardike-ad

১৯৭৯ সালের ২৬ অক্টোবর আততায়ীর হাতে নিহত হন তৎকালীন স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট পার্ক জং হি (ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে’র পিতা) । প্রেসিডেন্ট পার্ক নিহত হওয়ার পরে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে আসছিলেন ছোয়ে কুয়ু হা। কিন্তু অল্পকিছুদিন যেতে না যেতেই প্রেসিডেন্টের কোন অনুমোদন ছাড়াই সামরিক ক্যু’র মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জন দু হোয়ান মার্শাল ল জারী করেন এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ঝং সুং হুয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করেন যা দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে “Coup d’état of December Twelfth” বা “12.12 Military Insurrection” নামে পরিচিত। জেনারেল জন দু হোয়ানের এই অবৈধ মার্শাল ল জারীর প্রতিবাদে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় সবকটি বড় শহরে  প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেন সর্বস্তরের জনগণ।

এরই অংশ হিসেবে জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং জোসন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ইউশিন সিস্টেমের (তৎকালীন একীভুত ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধান) বিরোধিতা জানায় এবং এর সাথে জড়িত প্রফেসরদের পতত্যাগ দাবি করে। এছাড়াও তারা ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট মুভমেন্টের নেতৃত্ব দানের লক্ষে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের নির্বাচনের জন্য একটি প্রাথমিক কমিটি গঠন করে ও নির্বাচনে পার্ক গিওন হিউন নামে আইনের একজন ছাত্র, স্টুডেন্ট কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং এই কমিটিই খোয়াংজু বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদান করে। মে মাসের ৮ তারিখে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের আয়োজনে জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা একটি র‌্যালির আয়োজন করে এবং সেখান থেকে তারা ১৪ই মে’র মাঝে মার্শাল ল প্রত্যাহারের দাবি জানায় যাতে জোসন

army
সেনা বেষ্টনী ভেঙ্গে মিছিলের প্রস্তুতি

ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট কাউন্সিল কমিটিও একাত্বতা জানায়। তাদের এই র‌্যালি এবং দাবির সাথে অনেক শিক্ষকও একাত্বতা জানান।

এই আন্দোলন চলে টানা সাত দিন এবং স্টুডেন্ট কাউন্সিলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অষ্টম দিন অর্থাৎ ১৫ই মে দুপুর দুইটায় সাত হাজারেরও বেশী শিক্ষার্থী জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটকে সেনা বেষ্টনি পেরিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে। বেলা তিনটা নাগাদ শিক্ষার্থীরা ডাউনটাউনে অবস্থিত প্রভিন্সিয়াল হলের সামনে র‌্যালি নিয়ে পৌছায় এবং সাধারন জনগণও তাতে অংশ নেয়া শুরু করে। এই বিক্ষোভ গড়ায় পরেরদিন পর্যন্ত এবং পরেরদিন অর্থাৎ ১৬ই মে প্রভিন্সিয়াল হলের সামনে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাধারন জনগণ র‌্যালি ও অবস্থান কর্মসূচী নেয়।  ১৬ই মে দিন শেষে রাতে তারা সেখানে মশাল প্রজ্জ্বলন কর্মসূচীর আয়োজন করে।

বিপুল সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশও বিক্ষোভকারীদেরকে সাধারনভাবে সাহায্য করা শুরু করে। এরপর ১৭ ও ১৮ই মে ছাত্রদের পক্ষ থেকে সকল কর্মসূচী স্থগিত রেখে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা হয় এবং ঘোষণা দেয়া হয় যে, যদি মার্শাল ল বাতিল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা না হয় তবে ১৯ মে থেকে তারা পুনরায় আন্দোলন শুরু করবে এবং সেখান থেকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ছোয়ে’র অভিসংশনের দাবি জানাবে।

art
শিল্পীর তুলিতে ১৮ই মে

১৭ই মে সকাল ১০ টায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ছোয়ে’র কাছে প্রস্তাব রাখা হয় যেন মার্শাল ল’র বর্ধিতকরণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণাসহ সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবি জানানো হয় এবং প্রসিডেন্ট ছোয়ে তা অনুমোদন করেন। এর ফলে জেজু দ্বীপ সহ পুরো দেশেই আবারোও মার্শাল ল বজায় থাকে। এসময় প্রায় ২৬ জন রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয়। সিউলের ইউহোয়া উইমেন ইউনিভার্সিটি থেকে ১ জন শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে কয়েকশ ছাত্র-জনতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এদিকে খোয়াংজুতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা তখনও সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।

ট্রাজেডির শুরু

বর্ধিত মার্শাল ল ঘোষণার মুহূর্ত, ১৭ মে সকাল ৯টা ৪০ মিনিট। সব কটি বড় শহরে বিপুল সংখ্যক সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং সিউল-খোয়াংজু’র বিদ্রোহ দমনই ছিল এর উদ্দেশ্য। এর মাঝে ১ম, ৩য়, ৫ম, ৯ম, ১১তম ও ১৩ তম প্যারাট্রুপার ব্রিগেডকে রাজধানী সিউলে মোতায়েন করা হয় এবং ৭ম প্যারাট্রুপার ব্রিগেডের ৩৩তম ও ৩৫তম ব্যাটেলিয়ানকে খোয়াংজু’র জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং জোসন ইউনিভার্সিটিতে মোতায়েন করা হয়। এর মধ্যে ১৭ই মে রাতে খোয়াংজু’র সকল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। ১৮ই মে সকালে জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা লাইব্রেরীর দিকে অগ্রসর হতে চাইলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়। একই সময়ে সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা জন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রধান ফটক কর্ডন করে রাখে। সকাল ১০টায় প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থী প্রধান ফটকের ব্রিজের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই তাদের সংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ২০০ তে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মার্শাল ল প্রত্যাহার, শিক্ষাপ্রতিষ্টান খুলে দেয়ার দাবিতে স্লোগান দেয়া শুরু করলে তাদের উপর হামলা চালায় সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা। এতে সেখানে ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।

এরপর শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে এবং খোয়াংজু স্টেশনে একত্রিত হয়ে আরো তিন-চারশ শিক্ষার্থী নিয়ে প্রভিন্সিয়াল হলের দিকে এগোতে শুরু করে। বিকেল ৪টার দিকে  সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা প্রভিন্সিয়াল হলের দিকে অবস্থান নেয় ও বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার উপর আক্রমণ শুরু করে। তবে আক্রমণের সময় সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপারদের মুল লক্ষ্যবস্তু ছিল বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বয়সীরা। উল্লেখ্য সেসময় জল্লা রাজ্যের (গোয়াংজু যে রাজ্যে অবস্থিত) বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ কিম দে জুংকেও গ্রেফতার করা হয়। কিম দে জুং এর গ্রেফতার ও বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের উপর সেনাবাহিনীর হামলা সাধারণ জনগণের মনে ব্যাপক নাড়া দেয়। সন্ধ্যার দিকে ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ প্রভিন্সিয়াল হলের পাশে অবস্থান নিয়ে প্যারাট্রুপারদের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। এ অবস্থা পরদিন ১৯ মে পর্যন্ত গড়ায়। এর মাঝে সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা শহরের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষের উপর হামলা ও ধড়-পাকড় অব্যাহত রাখে। এসময় প্রায় ৪০০ জন মানুষকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯ মে সকাল ১০ টায় ডাউনটাউনের গুমনাম সড়কে প্রায় তিন হাজার মানুষ সমবেত হয় যার অধিকাংশই ছিল সাধারণ জনগণ। এরপর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে পুলিশ ও সেনাবাহিনী মিলে তাদের উপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করা শুরু করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতাও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং আধা ঘন্টাব্যাপী এই সংঘর্ষ চলে। এরই মধ্যে ৩০ টি ট্রাকে করে ১১তম প্যারাট্রুপার ব্রিগেডের ১১৪০ জন সৈন্য ডাউনটাউনের গুমনাম সড়কে এসে পৌছলে শুরু হয় মুল হত্যাকান্ড। সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা সেসময় নির্বিচারে হামলা চালানো শুরু করে।

এই অচলাবস্থা গড়ায় পরদিন ২০ মে পর্যন্ত। ২০ মে গুমনাম সড়কে ১ লাখ মানূষ সমবেত হয়। এসময় সরকারের কর্মকান্ডের বিরোধিতা করে লিফলেট বিতরণ করা হয় যা আগের রাতে শিক্ষকরা তৈরী করেছিলেন। বিকেল ৩ টার দিকে পুলিশ আবারো কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করা শুরু করে। পুলিশের পুলিশের কাঁদুনে গ্যাসকে উপেক্ষা করেই সেখানে আরো জনগণ বিক্ষোভে যোগ দিতে থাকে। সন্ধ্যা ৭ টার সময়  প্রায় ২০০ জন ট্যাক্সি ড্রাইভার গুমনাম সড়কে তাদের ট্যাক্সি নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেয়। এসময় তারা ট্যাক্সির হেডলাইট সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপারদের দিকে একিভুত করে রাখলে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে ট্যাক্সিগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের উপর নির্যাতন চালায়। রাত ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনগণ বিভিন্ন যানবাহন ব্যাবহার করে  রেল স্টেশনে থাকা সেনাবাহিনীর ৩য় ব্রিগেডের উপর হামলার চেষ্টা করে। এসময় ২ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন। একই সময়ে  ট্যাক্স অফিস ও জোসন ইউনিভার্সিটিতে গুলি ছুড়ে সেনাবাহিনী । খোয়াংজু বিপ্লবে এটিই ছিল প্রথম গুলি চালানোর ঘটনা।

পরদিন ২১ মে। মধ্যরাত থেকেই ট্যাক্স অফিসের সামনে আগুন জালিয়ে রেখেছিল বিক্ষুব্ধ জনগণ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র তাদের উপর ব্যাবহার করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে পরবর্তীতে তারা  ট্যাক্স অফিসেও আগুন দেয়। আগের রাতের নিহত হওয়া দুজনের লাশ ডাউনটাউনে আনা হয়। শুরু হয় আবারো বিক্ষোভ। এসময় আশেপাশের ব্যাবসায়ী গৃহবধুরা এগিয়ে দেন খাদ্য সামগ্রী। সবার চোখে বিপ্লবের আগুন আর মুক্তির স্বপ্ন। সকাল ১০টা বাজতেই প্রায় ১ লক্ষ্য মানুষে ভরে উঠে গুমনাম সড়ক।

সকাল ১০টা ১০ মিনিটে মার্শাল ল কমান্ডার হি সং, খোয়াংজু’র পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনে হামলার নির্দেশ দেন। বেলা ১টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপাররা প্রভিন্সিয়াল হলের সামনে থাকা বিক্ষুব্ধ জনগণের উপর গুলি চালানো শুরু করে। আশেপাশের ভবন থেকে Sniper যোগেও হামলা চালানো হয়। প্রায় ১০ মিনিট ধরে এই হামলা চলে। মুহুর্তের মধ্যেই বিক্ষোভ পরিণত হয়ে শোকে। রাস্তায় মেলে শুধু লাশ আর রক্ত। আহতদের রোনাজারীতে কেঁপে উঠে পুরা ডাউনটাউন। সেই ঘটনায় ঠিক কতজন নিহত হয় তা আজোও অজানা, অনেকে আজোও নিখোঁজ। তবে সেনাবাহিনী ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর ভাষ্যমতে ৫৪ জন নিহত ও ৫০০ জনেরও বেশী আহত হয়েছিলো।

মে’১৮ মেমোরিয়াল পার্ক

এরপর সেদিনই বিক্ষুব্ধ জনগণ আরো উত্তেজিত হয়ে আশেপাশের পুলিশ স্টেশনগুলোতে হামলা চালিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় ও সিটিজেন আর্মি গঠন করে। গোয়াংজু পার্কের সিটিজেন হলকে সিটিজেন আর্মির সদর দফতর হিসেবে ঘোষণা করে। সেদিনই বেলা ৩টা ২০ মিনিটে সিটিজেন আর্মির পক্ষ থেকে পাল্টা হামলা চালানো শুরু হয়। সেদিন রাত ৮ টার দিকে প্রভিন্সিয়াল হলের ভিতরে প্রবেশ করে সিটিজেন আর্মি । পিছু হটে সেনাবাহিনী। এভাবেই খোয়াংজু কারাগার ব্যতিত অন্য সব স্থান থেকে পিছু হটে সেনাবাহিনী।

এরপর শুরু হয় আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও চিকিৎসার পালা। বাস, প্রাইভেটকার, এমনকি মানুষ স্ট্রেচারে করে পাঁয়ে হেঁটে আহতদেরকে পৌছে দেয় হাসপাতালে। সাধারন মানুষ এমনকি পতিতালয় থেকে পতিতারাও হাসপাতালে স্বেচ্ছায় রক্ত দেয়ার জন্য আসে। এ যেন মানবতার এক মহামিলন।

২১ তারিখের পরে মকপোর দিকেও খোয়াংজু বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। এসময় প্রায় ২০০ জন আমেরিকার নাগরিক যারা গোয়াংজুতে থাকতেন, তারা উড়োজাহাজযোগে পলায়ন করেন।

বিপ্লবের ৫ম দিনে ২২ মে জনগণ আবারো প্রভিন্সিয়াল হলের সামনে সমবেত হয় ও বিক্ষোভ-বিদ্রোহে বিদ্ধস্ত শহর পরিস্কার করা শুরু করে, অন্য দিকে সিটিজেন আর্মি পুনরায় খোয়াংজু পার্কে একত্রিত হয়।

এরপর খোয়াংজুতে প্রশাসনিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের নিমিত্তে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। একটি ছাত্রদের নিয়ে ও অন্যটি পেশাদার গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গকে নিয়ে। এই কমিটি শহরের নিরাপত্তা সহ পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র সমর্পণ, সরকারের কাছে জনগনের দাবি-দাওয়া উপস্থাপনের কাজগুলো সম্পাদন করে। সাধারন জনগণও এগিয়ে আসে।

এরি মাঝে গোয়াংজু বিপ্লবকে দমন করতে মার্কিন-কোরীয় যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে ২৬ ও ২৭ মে কয়েক দফায় খোয়াংজুতে হামলা চালানো হয়। ২৭ তারিখে সিটিজেন আর্মিও পাল্টা হামলা চালায়। এসময় প্রভিন্সিয়াল হলের দখল নিয়ে নেয় সেনাবাহিনী। শেষ হয় ১০ দিন ধরে চলা বিপ্লব। মাত্র ৯০ মিনিটে এই বিপ্লব দমন করে সেনাবাহিনী। ২৭ তারিখ থেকে পুনরায় মার্শাল ল’র আওতায় চলে আসে গোয়াংজু শহর। পুনরায় মার্শাল ল’র আওতায় চলে আসলেও জনগণের মনে গেঁথে থাকে সিটিজেন আর্মির আওতায় থাকা ৬ দিনের গোয়াংজু শহর যা পরবর্তী সময়ে প্রেরণা জুগিয়েছে গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করতে।

১০ দিন ধরে বিপ্লবে ঠিক কতজন মানুষ নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসেব না থাকলেও সরকারী সুত্রগুলো থেকে বলা হয় যে মোট ১৬৫ জন মানুষ মারা যান যাদের মাঝে ৭৬ জনের লাশ আজোও মেলেনি। তবে সংবাদমাধ্যমসহ বেসরকারী সুত্রগুলোর মতে নিহতের সংখ্যা ১০০০ থেকে ২০০০ জন। খোয়াংজু বিপ্লবে সেনাবাহিনীর ২৩ জন ও পুলিশের ৪ জন সৈনিকও নিহত হন বলে জানা গেছে।

বিপ্লব পরবর্তী সময়

খোয়াংজু বিপ্লব দমনের পর জল্লা রাজ্যের রাজনীতিবীদ কিম দে জুংকে মুল দায়ী করে বিচার শুরু করা হয়। এসময় মোট ১৩৯৪ জনকে খোয়াংজু বিপ্লবে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় যাদের মধ্যে ৪২৭ জন অভিযুক্ত বলে প্রমাণিত হন, এর মাঝে ৭ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে দ কিম দে জুং’র মৃত্যুদন্ড মওকুফ করা হয়।

১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ১৯৮৮ সালে সংসদে ১৯৮০ সালের খোয়াংজু বিপ্লব নিয়ে শুনানী হয় এবং তাতে উক্ত ঘটনাকে “Gwangju People’s Uprising”এর পরিবর্তে “Gwangju Uprising” নামে অভিহিত করা হয়।

১৯৯৫ সালে জনগনের ব্যাপক চাপের মুখে সংসদে ১৮ই মে’র গণতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়ে বিশেষ আইন প্রনয়ন করা হয়, যার ফলে ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সামরিক ক্যু’র সাথে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৯৭ সনে তাদের জড়িতদের সাজা কার্যকর করা হয়, তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল জন দু হানের সাজা মৃত্যুদন্ড থেকে কমিয়ে  যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং সামের শাসনামলে বিশেষ বিবেচনায় সকলকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেয়া হয়।

১৯৯৭ সালেই মে ১৮ কে “official memorial day” ঘোষনা করা হয় এবং ২০০২ সালে মাংঅলদং কবরস্থানকে জাতীয় কবরস্থান ঘোষণা করা হয়।

খোয়াংজু বিপ্লব ও তার অনুপ্রেরণা

১৯৮০ সালে গোয়াংজুতে ঘটে যাওয়া সেই রক্তাক্ত ঘটনা পরবর্তীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় গনতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি উল্লেখযোগ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। ১৯৯৪ সালের ৩০ আগস্ট গোয়াংজু শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় “The May 18 Memorial Foundation” যা একটি অলাভজনক সংস্থা, যার উদ্দেশ্য ১৯৮০ সালের ঘটনাকে স্বরণে রাখা এবং তার স্মৃতি ধরে রাখা এবং এর চেতনা ধরে রাখা । ১৯৮০ সালের ঘটনায় নিহত ব্যাক্তিবর্গের পরিবারকে ক্ষতিপুরণ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে তারা এই অর্থ না নিয়ে The May 18 Memorial Foundation এ ব্যবহার করার দাবি জানান। এই ফাউন্ডেশনটি ২০০০ সাল থেকে শুরু করে  প্রতি বছর এশিয়ায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য ‘Gwangju Prize for Human Rights’ প্রদান করে আসছে। এছাড়াও ফাউন্ডেশনের পাশেই  গড়ে উঠেছে একটি পার্ক ও সংগ্রহশালা।

২০১৭ সালে খোয়াংজু বিপ্লবের প্রতিফলন

১৯৮০ সালে লাখো মানুষের প্রতিবাদে যেমন অবৈধ সামরিক শাসন কয়েকদিনের জন্যহার মেনেছিল ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেও সেরকমি লাখো-লাখো মানুষ প্রতিবাদে নেমেছিল প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে। সিউলের রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল ১০ লাখের মত মানুষ। খোয়াংজুসহ অন্যান্য শহরেও বড় ধরনের বিক্ষোভের আয়োজন হয়। অবশেষে ২৬ শে মার্চ ২০১৭ আদালতের রায়ে দুর্নীতির দায়ে অভিসংশিত হন দক্ষিন কোরিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে। গতবছর ৯ মে আয়োজিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৪১.০৮ শতাংশ ভোটে জয়লাভ করেন ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ কোরিয়ার “মুন জে ইন” । ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট পার্ক গুন হে’র অভিসংশন ও নতুন নির্বাচনকে সেই ১৯৮০ সালের ১৮ই মে বিপ্লবের প্রতিফলন হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকগণ। কোরিয়ান জনগণের মনে আজোও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার চেতনা অটুট রয়েছে।

আ.স.ম. ওয়ালীউল্লাহ, শিক্ষার্থী, খোয়াংজু ইন্সটিটিউট অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি।