Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে

malaysia-universityএশিয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ কয়েকটি দেশের মধ্যে মালয়েশিয়া অন্যতম। ইতোমধ্যে শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য ও তথ্য-প্রযুক্তিতে বিশ্বে নিজেদের স্থান বেশ পাকা করে নিয়েছে দেশটি। বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশের শিক্ষার্থীরা দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভিড় করছেন তাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা অর্জনের জন্য। এর মধ্যে দেশটিতে অনেক বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থীও রয়েছেন। অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সভা সেমিনারে অংশগ্রহণ করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশের ভাবমূর্তি প্রতিনিয়তই উজ্জ্বল করে চলেছেন। তবে কিছু শিক্ষার্থীর কারণে দেশের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হচ্ছে না তাও নয়। মালয়েশিয়ায় বিদেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অবস্থান শীর্ষে। তবে এখন দেশটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গমনের হার কমছে।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছিল ৪২২ শতাংশ। ওই বছর উচ্চশিক্ষার্থে মালয়েশিয়ায় গমনকারী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৪ হাজার ১৫৫। অন্যদিকে ২০১৭ সালে দেশটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পাড়ি জমিয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪৫৬ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশটিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে গমনকারী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর হার কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

chardike-ad

জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাজের অনুমতি দেয়া হয় না। যদিও পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের প্রলোভনে স্টুডেন্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী। এ ক্ষেত্রে মূলত বিভিন্ন এজেন্টের প্রলোভনে পড়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া মানব পাচারেরও শিকার হয়েছেন অনেকে। এসব ঘটনায় মালয়েশিয়া সরকারও এখন বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছে। বিদেশি শিক্ষার্থী গ্রহণের আড়ালে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কয়েকশ ভুয়া কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। মূলত এসব কারণেই দেশটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী গমনের হার কমছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থী ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

প্রফেসর ড. এসএম আব্দুল কুদ্দুছ এ বিষয়ে বলেন, মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষার মান আমাদের দেশের তুলনায় খুব একটা ভালো বলা যাবে না। তারপরও পড়ালেখার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের আশায় দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তবে সে দেশে ওই অর্থে শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ নেই। তাই যারা আসছেন, হতাশ হয়েছেন। এসব বিষয়ে বিভিন্ন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় এখন মালয়েশিয়ামুখিতা কমেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থী পাঠানোর সঙ্গে একটি চক্র বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় স্টুডেন্ট ভিসার আড়ালে মানব পাচার করত। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। এরপর থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের সচেতনতা এসেছে। পাশাপাশি মানব পাচারের বিষয়টি মালয়েশিয়া সরকারের নজরে আসার পর তারাও স্টুডেন্ট ভিসার বিষয়ে আগের তুলনায় বাড়তি কড়াকড়ি আরোপ করেছে।

এ প্রসঙ্গে মালয়া ইউনিভার্সিটির স্কলার খালেদ শুকরান জানান, মালয়েশিয়াগামী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। দেশটির সরকার অসংখ্য ভুয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে মালয়েশিয়ায় শিক্ষার্থী গমনের হার আরও কমবে। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমলেও আশার বিষয় হচ্ছে; এখন যারা আসছেন, তারা প্রকৃত অর্থেই পড়ালেখা ও গবেষণার উদ্দেশ্যে আসছেন। আমরা যারা ভালোভাবে কাজ করার চেষ্টা করি, তাদের জন্য বিষয়টি খুবই সুবিধার হয়েছে।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী, এজেন্ট ও সংশ্লিষ্ট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে মালয়েশিয়ার স্টার মিডিয়া গ্রুপের তরুণদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশনকারী প্লাটফর্ম আর এইজ। এতে দেখানো হয়েছে, শিক্ষার্থী পাচারের উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় বেসরকারি বিভিন্ন কলেজ গড়ে উঠেছে। এসব কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত না হলেও ভর্তি দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায় করছে পাচারকারী চক্র।

দেশটিতে ছাত্রজীবন পার করছেন ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া’র (ইউপিএম) পিএইচডি গবেষক মো. আব্দুর রউফ শিবলু। তার গবেষণার বিষয়, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশনাল স্টাডিজ। বাংলাদেশের ডিপ্লোমা করা ছাত্রছাত্রীদের ইংরেজি কমিউনিকেশন বৃদ্ধির জন্য ইংলিশ ফর প্যাসিফিক পারপাজ (ইএসপি) ভিত্তিক সিলেবাস প্রয়োগ নিয়ে তার বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি ল্যাংগুয়েজ এবং লিটারেচারে অনার্স শেষে এশিয়া ইউরোপ ইনস্টিটিউট স্কলারশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি মালায়া থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ২০১২ সালে। ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার ইউনিভার্সিটি রিয়াও’র আয়োজিত দ্বিতীয় শিক্ষা কনফারেন্সে শ্রেষ্ঠ লেখা নির্বাচিত হয় তার। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে নিয়মিত গবেষণামূলক লেখালেখি করেন।

মঙ্গলবার আব্দুর রউফ শিপলু নিজের সাফল্যের কথা এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরলেন। জানালেন, একটু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে একজন ভালো স্টুডেন্ট হওয়া সম্ভব। আর একজন ভালো স্টুডেন্ট পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় গিয়ে ঠেকবেন না। তারা নিজের মতো করে মানিয়ে নিতে পারবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অনেক ভালো স্টুডেন্ট এখানে আসেন। মালয়েশিয়া দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের দিকে। বিশ্বের সঙ্গে তালমিলিয়ে তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আরও এক ধাপ এগিয়েছে। এখানে এক ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও।

শিপলু বলেন, বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থীর নামে মানবপাচার করে বাঙালিদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ফলে আমাদেরও স্টুডেন্ট হিসেবে মাঝে মাঝে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। এর সমাধান হওয়া দরকার।

বিদেশে পড়াশোনা প্রসঙ্গে শিপলু বলেন, আমাদের দেশেও অনেক ভালো পড়াশোনা হচ্ছে। কিন্তু বিদেশে পড়াশোনা করলে অনেক দেশের শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিচয় হয়। জানা যায় তাদের দেশের কৃষ্টি, আচার-আচরণ। সবকিছু মিলিয়ে একটা মিশ্র অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। বহু ভাষা শেখা যায়। প্রবাসে একজন অল্প শিক্ষিত মানুষ সহজে ভাষা শিখে ফেলতে পারেন।

ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ২০১৯ সালের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণামূলক শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য সেরা ২০০তম স্থানে উঠে আসে। শতাধিক বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীও রয়েছেন এখানে, যাদের মধ্যে ৬৫ জন পিএইচডিতে এবং বাকি সবাই মাস্টার্স ও অনার্স প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত। এগ্রিকালচার ফ্যাকালটিতে প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০জন সরকারি কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি স্কলারশিপ নিয়ে গবেষণা করছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাংলাদেশি পিএইচডি গবেষক মা. নাজমুল হক সুমন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে সাইকোলজিতে অনার্স সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়াতে ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশনাল সাইকোলজি পিএইচডি করছেন।

সুমন বলেন, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া হতে পারে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার চমৎকার ও সাশ্রয়ী গন্তব্য। দেশের যে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সমান খরচ দিয়ে মালয়েশিয়ায় বিশ্বমানের ডিগ্রি নেয়া যায় বলেও জানান তিনি। সেই সঙ্গে বাড়তি বোনাস হিসেবে পার্টটাইম কাজের সুযোগ তো রয়েছেই।

বাংলাদেশসহ বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্যম আয়ের পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এখন মালয়েশিয়ায় তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য আসছেন। মানের দিক দিয়ে মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষা এখনও এশিয়ার চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের পর্যায়ে না গেলেও দেশটি এ বিষয়ে বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন- যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মালয়েশিয়ায় তাদের ক্যাম্পাস খুলেছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার নিজস্ব বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটিও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইউনিভার্সিটি মালয়া, ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়া, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মালয়েশিয়া, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স মালয়েশিয়া, ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া, ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি পেট্রোনাস ও মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি।

বিদেশে পড়াশোনার যোগ্যতা অর্জনের বিষয়ে সুমন বলেন, প্রথমে ভালো ইংরেজি জানতে হবে। ইংরেজি ভালো জানলে ভালো জব পাওয়া যাবে। আর একজন শিক্ষার্থীর বড় সফলতা হলো ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারা। ইংরেজি একজন শিক্ষার্থীকে বিদেশের মাটিতে স্মার্ট বানায়।

লেখক- আহমাদুল কবির, সৌজন্যে- জাগো নিউজ