ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়ে প্রবাসে এসে শামিল হচ্ছেন মৃত্যুর মিছিলে। আর এই আকস্মিক মৃত্যু দিনেদিনে বেড়েই চলেছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের তুলনায় ২০১৮ সালে প্রবাসী মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। যদিও এটি দেশে ফেরত আসা বৈধ শ্রমিকের মরদেহের হিসাবমাত্র।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। এদের অধিকাংশেরই বয়স ২৫-৩৫ বছরের মধ্যে। অভিবাসন ব্যয়ের তুলনায় কম আয়ের কারণে মানসিক চাপ ও দীর্ঘদিন স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে একাকিত্বই প্রবাসী শ্রমিকদের হৃদরোগের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি দৈনিক ১২-১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম, অপর্যাপ্ত খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকার কারণেও রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা।
তাই মানসিক চাপ কমাতে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।
মালয়েশিয়ার মাহাসা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ডা. আবুল বাশার বলেন, ‘প্রবাসীরা বিভিন্ন ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকায় তাদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তের হার বেশি। এ ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়ার পর তাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আসে, যা হৃদরোগের জন্য দায়ী। আবার অনেকে জানেন না, কোথায় কীভাবে চিকিৎসা নিতে হয়। কোনো ধরনের চেকআপের মধ্যে না থাকায় অনেকে হৃদরোগে ভুগলেও চিকিৎসা না করায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান’
চিরনিদ্রায় শায়িত জীবন যুদ্ধে হারমানা মালয়েশিয়া প্রবাসী রতন (৩৫)। অবুঝ দুই শিশুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই চলে গেলেন তিনি। আজ ভোর ৫টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল অন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছলে ছোট ভাই মনি রতনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। বেলা সাড়ে ১১টায় নরসিংদী বেলাবু গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানা গেছে।
এ প্রবাসী ২০১৮ সালে কলিং ভিসায় আসারপর মেডিকেলে আনফিট হওয়ার কারণে কোম্পানি ভিসা করতে পারেনি। ফিরতি তাকে কোম্পানি থেকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলে সেই সময় রতন কোম্পানি থেকে চলে আসেন। কারণ ধার-দেনা করে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় এসেছেন পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে।
অবৈধ অবস্থায় কয়েকদিন অন্য জায়গায় কাজ করার পর হার্ট স্ট্রোক করলে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব অব মালয়েশিয়ার সভাপতি মনির বিন আমজাদের আর্থিক সহায়তায় ও ভৈরবের মনিরুজ্জামান নরসিংদীর মোক্তার মিয়ার সার্বিক সহযোগিতায় গত ২১ মে সারডাং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সুস্থ করে তুললেও গত ২ জুন উচ্চ রক্তচাপে আবার স্ট্রোক করলে ৫ জুন রতনকে ফের কুয়ালালামপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে তার অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১১ জুন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এ রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
প্রবাসী শাহ আলম হাওলাদার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিবাসী কর্মীরা ঋণ নিয়ে বিদেশে যায়। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার পর যে বেতনের কথা তাদের বলা হয়, সে পরিমাণ তারা পায় না।’
তাদের ঘাড়ে ঋণের একটা বোঝা থেকে যায়। এক্ষেত্রে যেটা হয় অনেকেই এই চাপ নিতে পারে না। এতে তাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা কাজ করে, ফলে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘তাই এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা একটি স্ট্যান্ডার্ড কর্ম-পরিবেশে কাজ করছে এবং এটা সরকারকেই করতে হবে। আমি এও মনে করি, অভিবাসনের যে খরচ সেটা না থাকলে তাদের মধ্যে এই টেনশন কাজ করবে না। খরচ তুলে আনার বিষয়ে যে অস্থিরতা তাদের মধ্যে কাজ করে এটা আর থাকবে না।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে মোট ৩ হাজার ৭৯৩ বাংলাদেশি কর্মীর মরদেহ দেশে আনা হয়েছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৩৮৭। এ ছাড়া ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৪৮১, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৩০৭ ও ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৩৩৫ জন বৈধ কর্মীর মরদেহ দেশে এসেছিল। অধিকাংশের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে স্ট্রোক ও হৃদরোগ।
২০১৮ সালে ৩ হাজার ৬৭৬ জন বৈধ কর্মীর পাশাপাশি অবৈধভাবে কর্মরত ১১৭ জনের মরদেহও দেশে এসেছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫৩টি মরদেহ এসেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এ ছাড়া ৩৭৪টি মরদেহ এসেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ৬৬টি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
বেশির ভাগ মরদেহই এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে সৌদি আরব থেকে। আরবের পর বেশি মরদেহ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে।
সুস্থ দেহে দেশ থেকে যাওয়ার পরও প্রবাসী শ্রমিকদের স্ট্রোক ও হৃদরোগে মৃত্যু কেন বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী মো. হারুন আল রশিদ।
তিনি বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকরা বিদেশে পাড়ি দেয়ার আগে মেডিকেল চেকআপ করে যাচ্ছেন। সে সময় কিন্তু হৃদরোগ ধরা পড়ছে না। বিদেশে পৌঁছার পরও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় এ ধরনের কোনো উপসর্গ পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাভাবিক মৃত্যু কেন বাড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আর যেসব মৃত্যুর কারণ হিসেবে দুর্ঘটনা বা অন্যান্য রোগের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো কতটা ঠিক, তাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ বিমানবন্দরে মরদেহ আসার পর স্বজনরা প্রকৃত কারণ খোঁজার চেয়ে তাড়াতাড়ি দাফনেই বেশি গুরুত্ব দেন। বেশি ব্যয়ে বিদেশে গিয়ে প্রত্যাশিত আয় করতে না পারার কারণেও মানসিক চাপে থাকছেন অনেকে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ প্রবাসী শ্রমিকই দালালের প্রলোভনে বেশি ব্যয়ে বিদেশে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী বেতন পাচ্ছেন না, যা তাদের সবসময় মানসিক চাপের মধ্যে রাখছে। আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি।
অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ, যেমন প্রবাসী ভারতীয় ও নেপালের নাগরিকদের আকস্মিক মৃত্যুর হার কম। কারণ সেসব দেশের অভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম।
এ বিষয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম শাখার প্রথম সচিব মো. হেদায়েতুল ইসলাম মন্ডল বলেন, ‘শুধু যে স্ট্রোকের কারণে প্রবাসীরা মারা যায় তা না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ দেখা যায় দুর্ঘটনা, স্ট্রোক বা হৃদরোগ।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসীদের লাশ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। ব্যক্তিদের পরিবার লাশ দাফনের জন্য বিমানবন্দরে ৩৫ হাজার এবং পরে যারা বৈধভাবে কোম্পানিতে কাজ করেছেন তারা ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পায়।
আর যারা অবৈধ অবস্থায় কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন তাদের বেলায় কোম্পানির মালিকের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ আদায়ে দূতাবাস সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে। পাশাপাশি জনহিতৈইশীদের সহযোগিতাও নেয়া হয়।
প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী কর্মীদের পরিবারগুলোকে ২০১৮ সালে ১১৮ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছে বোর্ড। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০১ কোটি ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
লেখক- আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া থেকে