পলিটিক্যাল এসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় দীর্ঘদিন ধরেই বহুল জনশ্রুত একটি শব্দ। ভিন্ন দেশের নাগরিক হয়েও রাজনৈতিক আশ্রয়ে বিশ্বের অনেক দেশে বিদেশিরা বসবাস করছেন যুগের পর যুগ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিচ্ছে।
চলতি বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের পলিটিক্যাল এসাইলামের আবেদন বেড়েছে। এমনকি এর মধ্যে অনেকে শ্রমভিসায় বিদেশ গিয়েও রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে এমন বেশকিছু ব্যক্তির বিষয়ে খবর এসেছে, যারা শ্রমভিসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশ গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও কানাডায়। নরডিক দেশগুলোর মধ্যে সুইডেন এবং এশিয়ার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এছাড়া আমেরিকার কয়েকটি দেশেও আবেদন পড়েছে অনেক। তবে নতুন অভিবাসন নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে আবেদনের পরিমাণ কমেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক আশ্রয় বিষয়টি সবসময়ই সে দেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে। কারণ এর ফলে দেশটি সর্ম্পকে নেতিবাচক ধারণা নেয় আবেদন গ্রহণ করা দেশটি। এমনকি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর কারণে ওসব দেশের শ্রমবাজারেও প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের জন্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো পলিটিক্যাল এসাইলামের বিষয়ে সজাগ থাকলেও খুব বেশি রি-অ্যাকশান দেখায় না। কিন্তু এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পক থাকায় বিষয়টি প্রভাব ফেলে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদের শেষ বছর থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে বসবাসরত দেড় হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই নিজেদের বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী পরিচয় দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য এসেছে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরছেন তাদের নামে একাধিক রাজনৈতিক মামলার কথা। দেশে ফিরলেই পুলিশ তাদের আটক করবে। মামলার সপক্ষে তারা বিভিন্ন কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন।
এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) স্কিমের আওতায় নির্ধারিত সময়ে কাজের কন্ট্রাক্টে দেশটিতে স্থায়ীভাবে থাকার কোন সুযোগ নেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তারা দেশটিতে স্থায়ী হওয়ার জন্য এই অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলছেন, এতে দেশটির শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবছর রাজনৈতিক আশ্রয়ের পরিসংখ্যান প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে। চলতি বছরে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি। তবে সংস্থাটির এ সংক্রান্ত সেল থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত কয়েক বছর ধরে ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকে। এবারো তেমনই প্রবণতা রয়েছে। সংস্থাটির হিসেবে বাংলাদেশের প্রবাসীরা রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের উপরের দেশটি হচ্ছে সোমালিয়া। সংস্থাটির গত বছরের তথ্য মতে, ২০১৮ সাল থেকে আগের পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রায় দেড় লাখ মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার অন্তত ৩০ দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
এদিকে, মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা তথ্য মতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মতো রয়েছে- যারা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েছেন এখন। কিন্তু যারা বৈধভাবে শ্রমিক ভিসায় বিদেশ গিয়েছেন তারা নির্দিষ্ট মানদন্ড ও সাক্ষাৎকারের আওতায়, কিছু দেশে নির্দিষ্ট ইপিএস স্কিমের আওতায় জব পারমিট পেয়ে বিদেশ গেছেন। তখন তাদের কোনো রকম রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পায়নি সংশ্লিষ্ট দূতাবাস। এমনকি তাদের নিয়োগ দেয়ার সময় রাজনৈতিক পরিচয় নেই বলে অঙ্গীকারনামাও নেয়া হয়।
এখন তাদের রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় অবশ্যই ভূয়া বলে মন্ত্রণালয় মনে করছে। কিন্তু আবেদন পাওয়া দেশটি এ বিষয়ে চিঠি ইস্যুর মাধ্যমে বক্তব্য না চাইলে উক্ত দেশ বক্তব্য দিতেও পারে না। দেশের পক্ষ থেকে শুধু অবহিত করা যায় মাত্র।
সব মিলিয়ে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত দূতাবাস ও কনস্যুলেটের কাছ থেকে প্রাপ্ত এসব তথ্য উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ অভিবাসী অধিকার ফোরামের (বোয়াফ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই সরকার বিষয়টি নজরে রাখছে। কিন্তু যারা অবৈধভাবে সুযোগ নিতে চায়, তারা পায়তারা চালিয়ে যাবেই।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়ার পথ বন্ধ করা। দালালদের নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যারা যাবে, তাদের বিষয়ে আগেই সব তথ্য পরিষ্কার থাকবে। ফলে তারা পরবর্তীতে এ ধরনের আবেদন করলেও আবেদন বাতিল করার জন্য তার বিপরীতে শক্ত যুক্তি রক্ষিত থাকে।
এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভিবাসী কল্যাণ অনুবিভাগ) ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, বর্তমান সরকার নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরির বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের অপতৎপরতা এই সময়ে দেশের জন্য নেতিবাচক।
তিনি বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তসহ বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত থাকি। কিন্তু সমস্যা করে দালাল চক্র আর কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে আমাদের এ বিষয়ে আলাপ হবে।
সৌজন্যে- রাইজিংবিডি