দক্ষিণ কোরিয়া জাপানী পণ্য বর্জন করছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে বিরোধের যে বিস্তার ঘটেছে জনগণের মধ্যে তার সবচেয়ে লক্ষণীয় বহির্প্রকাশ হচ্ছে এই বয়কট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আচরণ নিয়ে উদ্ভূত বিরোধই এখন বাণিজ্য ও জাতীয় নিরাপত্তাগত বিরোধে বিস্তার লাভ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় শত শত পণ্য রফতানির ওপর জাপানের আরোপিত বিধিনিষেধ গত ২৮ আগস্ট থেকে বলবত হয়েছে। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়া বিতর্কিত উপসাগরীয় খাঁড়ি ডোকডোর চারপাশে সামরিক মহড়া বাড়িয়ে দেয়। গাড়িটি দক্ষিণ কোরিয়ার নিয়ন্ত্রণে তবে জাপান সেটিকে তার নিজের বলে দাবি করে। এরও ক’দিন আগে দক্ষিণ কোরিয়া জাপানের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদানের একটি চুক্তি স্থগিত রাখে।
আমেরিকার এই দুই মিত্র দেশের মধ্যে অবনতিশীল সম্পর্কের কারণে পূর্ব এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সাম্প্রতিককালে রাশিয়া ও চীন উত্তরোত্তর নিজেদের শক্তিমত্তা জাহির করছে। এই দুই দেশের আকাশসীমার গভীরে অনুপ্রবেশ করে তাদের ধৈর্য পরীক্ষা করে দেখছে। ওদিকে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক তার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচীর সম্প্রসারণ ঘটিয়ে চলেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে তিনি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা করেছেন যার লক্ষ্য আঞ্চলিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে যে বিরোধ চলছে বর্তমান সময়কার এসব হুমকির সঙ্গে তার তেমন কোন সম্পর্ক নেই। এর সবকিছুই হচ্ছে ইতিহাসের পুরনো অভাব অভিযোগকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে জাপানের কোরিয়া দখল ও যুদ্ধের সময় কোরীয় জনগণের ওপর জাপানের চাপিয়ে দেয়া ভয়াবহ সব দুর্ভোগকে নিয়ে। এসবকে কেন্দ্র করেই দু’দেশের বিরোধ গত বছর চরম আকার ধারণ করে যখন দক্ষিণ কোরিয়ার সুপ্রীম কোর্ট এই মর্মে রায় দেয় যে জাপানের যেসব কোম্পানি যুদ্ধের সময় দক্ষিণ কোরীয়দের দাস শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করেছিল তাদের এসব কোরীয়কে যারা এখনও বেঁচে আছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যদিকে জাপান বলে যে ১৯৬৫ সালের এই চুক্তি বলে এ জাতীয় দাবি-দাওয়া নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। গত জুলাইয়ে জাপান কিছু রাসায়নিক পদার্থ রফতানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এই বিরোধকে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসে। ওই রাসায়নিক পদার্থ দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম সর্ববৃহৎ শিল্প মেমোরি চিপ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য একান্তই প্রয়োজন। গত আগস্ট মাসে বিরোধটি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় জাপান জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তি তুলে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বাণিজ্য অংশীদারদের তালিকা থেকে দক্ষিণ কোরিয়াকে বাদ দেয়। পাাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া তখন জাপানের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদান সংক্রান্ত কমিটি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা এমনিতেই চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তার ওপর এখন জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিরোধ তীব্র রূপ নিলে তাদের ব্যবসা মার খেতে বাধ্য। আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়াটা আরও মারাত্মক ব্যাপার। গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের চুক্তিটি বাতিলের ফলে মার্কিন সৈন্য রাখার খরচাদি কিভাবে ভাগাভাগি হবে সে সংক্রান্ত আলোচনায় দক্ষিণ কোরিয়া ব্যাঙ্কফুটে যেতে বাধ্য হতে পারে। তা ছাড়া দু’দেশের এই বিরোধের বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে এসে পড়তে শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বলেছে যে তারা জাপানী পণ্য বয়কট সমর্থন করে এবং এতে অংশ নেবে। চার-পঞ্চমাংশ লোক বলেছে আপাতত তারা জাপানে অবকাশ যাপনে যাবে না। গত জুলাই থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় জাপানের বিয়ার কাপড়ের বিক্রিতে ধস নেমেছে। এয়ারলাইনগুলো অনেক জনপ্রিয় রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে।
জাপানের জনমত এখনও পর্যন্ত কোরীয়দের বিরুদ্ধে সোচ্চার নয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার সরকারের ভূমিকাকে সমর্থন করে। দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলো কোরীয়বিরোধী মনোভাব নানাভাবে উস্কে দিচ্ছে। এসব দেখে মনে করার কারণ আছে যে দু’দেশের এই বিরোধের দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। দু’পক্ষের কেউই নিজ নিজ অবস্থান থেকে পিছু হটার বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
সূত্র: দি ইকোনমিস্ট