Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিষাদের প্রবাস

malaysia-bd‘প্রদীপ একদিন নিভে যাবে, তবে কেন অবহেলায় জীবন অকালে হারাবে? প্রবাসী কবি বাশার খাঁন অপূর্বের এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে কীভাবে দেবে…। প্রবাসে পরিবারের কথা চিন্তা করে নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে আমরা কাজ করে যাই। পরিবারের কেহ যখন বলে কেমন আছো? তখন আমরা কষ্টে থাকলেও বলি ভালো আছি। পরিবারকে বুঝতে দেইনা কষ্টে আছি, কারণ তারা আমাদের জন্য চিন্তা করবে।

যখন শুনি প্রবাসে কেহ মারা গেছে, তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না, কারণ আমিও একজন প্রবাসী।’ একজন প্রবাসী হয়ে আরেকজন প্রবাসীর মৃত্যুর সংবাদটা শুনলে হৃদয়টা এমন মুচড়ে উঠবে এটাই হয়তো প্রবাসীদের ধর্ম। কৃষ্ণচূড়া আগুনের মতো শতশত তরতাজা প্রাণের বিদায় হচ্ছে প্রতিদিন।

১৩ অক্টোবর বাসার নিচে রেস্টুরেন্টে বসে প্রবাসী কবি বাশার খাঁন অপূর্বকে নিয়ে চা পান করছিলাম। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের মাতার গাঁও গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী মকবুল হোসেন ফোন করেছেন।

ফোনে বললেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পূর্ব বীরগাও ইউনিয়নের সলফ গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী আবুল বাশার (৬১) হার্ট অ্যাটাকে হাসপাতালে মারা গেছেন। (ইন্নালিল্লাহ…ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পাশে থাকা বন্ধু বাশার খাঁন অপূর্ব জানতে চান কি হয়েছে? বললাম আমার এলাকার একজন প্রবাসী কুয়ালালামপুর হাসপাতালে স্ট্রোকে মারা গেছেন। লাশটা দেশে পাঠাতে হবে।

মৃত্যুর কথা শুনে বাশার খাঁন অপূর্ব বললেন, জীবন প্রদীপ জানি একদিন সবার নিভে যাবে, তবে কেন অবহেলায় জীবন অকালে হারাবে? প্রবাসী কবি বাশারের এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে, কীভাবে দেবে। এর কিছু সময় পরে মালয়েশিয়া জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের অর্থ সম্পাদক ফোন করলেন। জানতে চাইলেন লাশটা দ্রুত কীভাবে পাঠানো যায়। লোকটা অনেক দুর্ভাগা ছিল। আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আবুল বাশারের নিথর দেহটাকে কফিনে বন্দি করে দুই একদিনের মধ্যে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ভাবা যায়? কিন্তু এটাই সত্য। আমরা ভাবি এক, হয় আরেক। জীবনের হিসেব মেলানো কোনো প্রবাসীর পক্ষেই আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। হয়তো হবেও না।

আবুল বশরের ২৬টি বছর মালয়েশিয়ায় প্রবাসজীবন কাটিয়ে মৃত্যুকে উপহার হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। আচ্ছা কফিনে পেরেক ঠোকার যন্ত্রণা এই প্রবাসী সইতে পারবে তো? যে স্বপ্ন ওকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাড়িয়ে নিয়েছে সেই স্বপ্ন কি ওকে এত সহজে মুক্তি দিয়ে দেবে? ওর কফিনে হাত রেখে খুব জানতে ইচ্ছে করে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান নাগরিক রাস্তা থেকে কুড়িয়ে কুয়ালালামপুর হাসপাতালে আবুল বাশারকে ভর্তি করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন আবুল বশর। সাতটি দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন তিনি। শেষ মুহূর্তে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে কী যেন খুঁজছিল, বলছিলেন হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তাররা। হয়তো হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত ভালোবাসাটুকু একমাত্র মেয়েকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিল কিংবা ব্যাকুল হয়েছিল স্ত্রী – মেয়ের স্পর্শের জন্য। ফুলের মতো আদরের মেয়ে শিলা বাবার নিষ্প্রাণ দেহটাকে পেলে কী যে করবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।

১৯৯৩ সালে আবুল বাশার মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। এর মধ্যে একবার মাত্র দেশে যান। তখন একমাত্র মেয়েটি শিলা ছিল ছোট্ট। আর যাওয়া হয়নি তার দেশে। ফোনে কথা হত একমাত্র মেয়ের সাথে। মেয়ে শিলা (২৮) বিয়ে দেয়া হয়েছে। শিলার দুটি ছেলে সন্তান। ২২টি বছর বাবার আদর যত্ন পায়নি। মৃত্যুর আগে ৬টি বছর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি বাশারের।

এরই মাঝে বাশারের বাবা-মা ও মৃত্যুবরণ করেছেন। দিরাই উপজেলার জদল ইউনিয়নের আতবাড়ি গ্রামের লন্ডন প্রবাসী মৃত সানাউল্লাহর মেয়ে আজিজুননেছা। সানাউল্লাহ মারা যাওয়ার আগে মেয়েকে লন্ডন নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু জীবিতাবস্থায় নিতে পারেননি। আপিল মামলার রায় পেয়ে দুই মাস আগে লন্ডন পাড়ি জমান আবুল বশরের স্ত্রী আজিজুননেছা।

তাও জানে না আবুল বশর। কারন আবুল বাশার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। একদিকে ভিসা সমস্যা। অন্যদিকে কাজ যোগাতেও তার কষ্ট হচ্ছে। এসব কারণে হয়তোবা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ১৭ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাকে দেখতে যায়নি। বা কেউ যোগাযোগ করেনি। টেনশনে পড়ে গেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

২৩ সেপ্টেম্বর আবুল বশর মারা যাওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তার পেন্টের পকেটে পেল বাংলাদেশের একটি মোবাইল নম্বর। সেটি আর কারও নয়। একমাত্র আদরের মেয়ে শিলার। সেই নম্বরে হাসপাতাল থেকে ফোন দেয়া হলো বাংলাদেশে। শিলাকে ফোন করে নিশ্চিত হলো হাসপাতাল কর্তৃক্ষ যে আবুল বাশার বাংলাদেশি নাগরিক।

শিলা ফোন পেয়ে সদ্য লন্ডনে যাওয়া মাকে ফোন করে জানাল, বাবার খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে জীবিত নয় মৃত। লন্ডন থেকে ফোন করা হয় প্রবাসী মকবুল হোসেনের কাছে। মকবুল হোসেন ছোটাছুটি করে আবুল বাশারের মরদেহ দেশে পাঠানোর সবরকম ব্যবস্থা করেছেন। বাংলাদেশে আবুল বাশারের লাশ গ্রহণ করবেন তার ভাতিজা মো. জুয়েল মিয়া। এদিকে স্বামীর মরদেহ দেখতে লন্ডন থেকে ১৯ অক্টোবর দেশে আসছেন আজিজুন নেছা।

আবুল বাশার কখনো কি ভেবেছিলেন জীবনের স্বপ্নগুলো এক নিমিষেই মিলে যাবে? কখনোই ভাবেনি। কারণ একজন খেটে খাওয়া প্রবাসী শ্রমিক কখনই এত সহজে মৃত্যুর কথা ভাবে না।

বাংলাদেশে হয়তো ওর নিষ্প্রাণ দেহটা পৌঁছে যাবে। সূর্যের বিকিরণে একদিন মিলিয়ে যাবে ওর নিথর দেহ কিন্তু আমার মতো হাজারো প্রবাসীর হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা হয়তো সহস্র বছর বর্ষার স্রোতেও মুছবে না। ভালো থেকো প্রবাসী। ওপারে ভালো থেকো।

লেখক- আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া থেকে

Facebook
Twitter
LinkedIn
Email