Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

বিদেশে টাকার পাহাড়

পোশাক শিল্পে মালিকরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা না দিলেও কানাডায় গড়ে তুলেছেন ‘বেগমপাড়া’। কানাডিয়ান একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাহেবরা থাকেন বাংলাদেশে, বেগমরা থাকেন টরেন্টোর ‘বেগমপাড়ায়’। শুধু তাই নয়, তারা নাগরিকত্ব নিয়েছেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। অনেকে মালয়েশিয়াকে বেছে নিয়েছেন সেকেন্ড হোম হিসেবে। বড় গার্মেন্ট মালিকের বেশির ভাগই এখন বিদেশি নাগরিক। বিদেশে তারা টাকার পাহাড় গড়েছেন। বেশির ভাগ অর্থই বন্ড সুবিধায় আনা মালামাল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেওয়া থেকে অর্জিত। তারাই আবার বিদেশে টাকা পাচারে বেছে নিচ্ছেন অবৈধ হুন্ডির পথ। এসব কারণে গার্মেন্ট শিল্প মালিকরা কর্মপরিবেশের দিকে কোনো মনোযোগ দিচ্ছেন না। হাতেগোনা কয়েকজন মালিক পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়েছেন। বাকিরা ব্যস্ত ভোগ-বিলাসে। সাধারণ শ্রমিকদের আর্তনাদ তাদের কানে যায় না। দিনের পর দিন এভাবেই চলছে। অথচ শ্রমিকরা তাদের পাওনা চাইলে বলা হয় ষড়যন্ত্র। শ্রমিকদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। ছাটাই থেকে শুরু করে জুলুম-নির্যাতন এমনকি জেল পর্যন্ত খাটতে হয় তাদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে দামি গাড়ির ব্র্যান্ড বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ গার্মেন্ট মালিকরা কিনছেন অহরহই। গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর একজন সাবেক সভাপতির বাসায় খাওয়ার পানি যায় সোনারগাঁও হোটেল থেকে। বিজিএমইএ ভবনে বসে সংগঠনটির নেতারা প্রতিদিন দুপুরে যে খাবার খান, তাও আসে পাশের সোনারগাঁও হোটেল থেকেই। আগুনে পুড়ে শতাধিক গার্মেন্ট কর্মী নিহত হওয়া তাজরীন গার্মেন্টের মালিক অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। সেখানে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আরও জানা গেছে, একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর চার সদস্যের পরিবারে বিএমডব্লিউসহ মোট গাড়ি রয়েছে সাতটি। আরেক ব্যবসায়ী যিনি বিজিএমইএর নেতা ছিলেন—তার ড্রয়িং রুমে রয়েছে আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যালারি।

chardike-ad

 

dollarঅন্য একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর গুলশানের বিলাসবহুল বাসায় রয়েছে টেনিস কোট ও সুইমিং পুল। পুলিশের এক সাবেক কর্মকর্তা যিনি বর্তমানে একটি গ্রুপের কর্ণধার। এই গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরে বাড়ি করেছেন। গ্রুপের তিনটি গার্মেন্টসের প্রায় তিন হাজার শ্রমিক তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেছে অসংখ্য বার। তবে যে শ্রমিকের রক্ত পানি করা হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ওপর পোশাক শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, আর মালিকরা শানশওকতের জীবন পেয়েছেন—সেই শ্রমিকের প্রতি ফিরে তাকানোর সময় যেন মালিকদের নেই। শ্রমিকের ভাঙা ঘরের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে পাথরচাপা বুকের বেদনা কমানোর কোনো উদ্যোগই নেন না এসব মালিক। শ্রমিকরা যখন তাদের নায্য পাওনা দাবি করে রাস্তায় নামেন, তখন একে বলা হয় ‘ষড়যন্ত্র’, গার্মেন্ট শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে।

সিপিডির প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ডবল হয়েছে। পাচার করা অর্থ দিয়েই এসব অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। আরেক তথ্য থেকে দেখা যায়, গত ১৩ বছরে মালয়েশিয়ার ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে ৩ হাজার ৬১ জন বাংলাদেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। কানাডার কিছু শহরে পাচারের টাকায় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের ‘বেগমপাড়া’। আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ নানা দেশে বাংলাদেশের অর্থ পাচারকারীরা বাড়ি-ঘর কিনেছেন। এসব দেশসহ ইউরোপের দেশে দেশে তাদের অনেকে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। এমনকি, ব্যাংক পর্যন্ত খুলে বসেছেন।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ হলো ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকারও বেশি। লেস ডেভেলপড কান্ট্রিস (এলডিসি) বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়—আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ইত্যাদি উন্নত ধনী দেশসহ ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ভোগ করছে। নিজস্ব অনুসন্ধানীমূলক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। আয়ের ৮০ শতাংশ নানা পথে বিদেশে চলে যাচ্ছে। কম দামে যন্ত্রপাতিসহ উৎপাদন সামগ্রী কিনে বেশি দাম দেখিয়ে হরহামেশাই অর্থ পাচার করা হচ্ছে। পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা এরূপ পাচারের সঙ্গে বেশি জড়িত। সংশ্লিষ্টরা বলছে, সরকারের কাছ থেকে ছলচাতুরির মাধ্যমে নেওয়া বিভিন্ন সুবিধার অপব্যহারকারী পোশাকশিল্প মালিকরা এখন অর্থ পাচারের শীর্ষে। তাদের এই অবৈধ কারবার চলছে বন্ডেড ওয়্যার হাউস বা বন্ড সুবিধার আড়ালে। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা শুল্কমুক্ত কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির ফলে ধ্বংসের মুখে পড়েছে টেক্সটাইল শিল্প। অনেকের পোশাক কারখানা না থাকার পরও, বন্ড লাইসেন্স নিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ার তথ্য মিলেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটে। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সর্বশেষ তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, বাস্তবে কোনো ধরনের পোশাক কারখানা না থাকার পরও ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে আছে বন্ড লাইসেন্স। এসব বন্ড লাইসেন্স ব্যবহার করে পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেছেন কালোবাজারের সঙ্গে জড়িত পোশাক শিল্প মালিকরা। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনও নিচ্ছে কাস্টমস।

জানা গেছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী ১৩৩টি পোশাক কারাখানা এবং এর ৪৪৬ পরিচালকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। দেশে এখন মোট ৬ হাজার ৫২৯ প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও, অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৬০ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২৪৩৭টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার। এত অনিয়মের পরও চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন ধরনের কর ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি পোশাক মালিকদের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ডের অপব্যবহার আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এটা বন্ধ করতে চাই। এজন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ ছাড়াও বন্ডকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। জানা গেছে, শুল্কমুক্ত সুবিধার আড়ালে বন্ডেড ওয়্যার হাউসে অনিয়মের শেষ নেই। পুনঃরপ্তানির শর্তে আমদানি করা কাপড় ও কাগজসহ অন্যান্য পণ্য ফ্রি-স্টাইলে বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে। বিক্রি করছে পোশাক শিল্প মালিকরা। এ সুবিধায় সরকার প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দিলেও, সেই শুল্কের টাকা লুটপাটে ব্যস্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ প্রতিদিন।