Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মাননীয় অর্থমন্ত্রী! প্লিজ! রাগ করবেন না!

মান্যবর জনাব,

অতীব ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং বিনম্র সম্ভাষণে আপনাকে জানাচ্ছি সালাম। আর মাত্র কয়দিন পর অর্থাৎ আগামী ৬ অক্টোবর আপনার স্বর্ণালি জীবন ৮১ বছরে পদার্পণ করবে। হেমন্তের প্রেম জাগানিয়া নির্মল বাতাসের স্পর্শ, সাদা মেঘের বর্ণিল রূপ এবং কাশফুলের মন মাতানো সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে আপনার জীবন নব-যৌবন লাভ করুক এই শুভ কামনা দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি।

chardike-ad

muhit গত ১০০ বছরে এই বঙ্গে আপনার মতো মেধাবী, চরিত্রবান এবং সফল সুপুরুষ খুব কমই জন্মেছেন। সারা জীবনের ছাত্রত্ব, কর্মবীরত্ব ও কর্ম-পরিবেশের নেতৃত্ব আপনাকে করেছে মোহনীয় এবং কমনীয়- তাই তো আপনার সামনে দাঁড়ালে সবাইকে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অঙ্ফোর্ড কিংবা হার্ভার্ডে আপনার অধ্যয়ন, পরবর্তীতে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস, স্বাধীন বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের কর্ম-ইতিহাস ছাপিয়ে গেছে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার গৌরবময় অধ্যাপনার কারণে। ১৯৮১ সালে অবসর গ্রহণের পর রাজনীতি, অর্থনীতি, গবেষণা, সামাজিক উন্নয়ন এবং সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে আজ আপনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি।

হে কর্মবীর! আপনার গৌরবের কারণে সবাই আপনাকে পেতে চাইবে। নারী চাইবে প্রিয়তম বানাতে, সন্তান চাইবে পিতার আসনে বসাতে, সুহৃদগণ চাইবে অন্তরঙ্গ বন্ধু বানাতে আর আমার মতো নবীনরা চাইবে- পিতামহ বা মাতামহের আনন্দ আসনে বসিয়ে আপনার স্বর্ণালি জীবনের স্বর্ণরেণুর স্বাদ আস্বাদন করার জন্য। আশা করি, নবীনদের আপনি সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত করবেন না। পিতামহ-মাতামহ বড় ভারিক্কি প্রকৃতির তদ্ভব শব্দ প্রমিত বাংলায় যার আদরণীয় প্রতিশব্দ হলো- দাদু ভাই। আপনার বয়সে এসে অনেক মহাপুরুষ-নবীনদের মুখ থেকে একটু দাদু ভাই ডাক শোনার জন্য চাতক পাখির মতো উদগ্রীব হয়ে থাকে। আমি অর্বাচীন, কেন প্রাচীনেরে সেই সুখ থেকে বঞ্চিত করব! তাই আপনাকে প্রিয় দাদু ভাইয়ের আনন্দ আসনে বসিয়ে কিছু নিরানন্দমূলক তিক্ত ভাষণ শোনাতে চাই। প্লিজ! রাগ করবেন না!

আমার প্রিয় দাদু ভাই! যে বিষয়ে আপনার পাণ্ডিত্য অর্থাৎ যে শিক্ষা দ্বারা আপনি নন্দিত তা হলো ইংরেজি সাহিত্য। ওখানকার তাবৎ দিকপাল যাদের লেখা গল্প, কবিতা, উপন্যাস আপনার মন মস্তিষ্ক, চিন্তা-চেতনা এবং আচার-আচরণ দখল করে আছে তারা কিন্তু বাস্তব জীবনে সবাই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। কারও ঘরে চাল ছিল তো চুলো ছিল না। অনেকে ছিলেন ভবঘুরে। বেশির ভাগই দ্বীন-হীন-দরিদ্র মানুষ হিসেবে মৃত্যু পর্যন্ত দুর্ভোগে ছিলেন কেবল দুমুঠো অন্ন জোগাড় করার জন্য। ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে তারা ছিলেন অসফল। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। কেউ কেউ প্রেম করতে গিয়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন বাস্তব ভেদবুদ্ধির অভাবের জন্য। পরকীয়া করতে গিয়েও তারা মারাত্দক অসফল হয়ে কেউ কেউ আত্দহত্যার চেষ্টা করেছেন। সেসব কবি, লেখক এবং সাহিত্যিকের অমূল্য রচনাসমূহ অধ্যয়ন করে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে প্রথমেই যে উল্টোরথে চলা আরম্ভ করলেন সেই পথ আজও শেষ হয়নি। আপনার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় দেশ-বিদেশের বহু অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেন- কিন্তু দিনান্তে একবারও পেছনে ফিরে চিন্তা করলেন না- কতটুকু সর্বনাশ ঘটল কিংবা সফলতাই বা কেমন হলো।

চুলচেরা বিশ্লেষণে আমি হয়তো আপনার সব পদের কর্মময় জীবনের কীর্তিগাথা বলতে পারব না কিন্তু নবম সংসদে আপনার সহকর্মী হওয়ার কারণে অনেক কিছুই বলতে পারব। সংসদে দাঁড়িয়ে আপনি একদিন বলেছিলেন- ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স নামের একটি কোম্পানিতে আপনার এবং আপনার ভাইয়ের কিছু শেয়ার ছিল মন্ত্রী হওয়ার পূর্ব থেকেই। তারা আপনাকে শেয়ারগুলো দিয়েছিল বলতে গেলে মাগনা। আশা ছিল, আপনার বহুমুখী অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা দিয়ে আপনি কোম্পানিটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবেন! কিন্তু তা হয়নি। আপনি সহজ-সরল শিশুর মতো সেদিন স্বীকার করেছিলেন, আপনি ওই কোম্পানির পরিচালক হওয়ার পর কোম্পানিটির দায়-দেনা এবং লোকসান আরও বেড়ে যায়। সেদিন সংসদে উপস্থিত আপনার অন্য সহকর্মীরা কি ভেবেছিলেন তা বলতে পারব না। তবে আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললাম- হায় আল্লাহ! দাদু বলেন কি? যিনি একটি লোকসানি কোম্পানিকে লাভজনক করার পরিবর্তে উল্টো কোম্পানির দায়-দেনা বাড়িয়ে দেন সেই তিনি ১৭ কোটি মানুষের অর্থমন্ত্রী হন কীভাবে! আমার সেদিন খুব ভয় হলো- আপনি হয়তো আগামী দিনগুলোতে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টরে অস্বাভাবিক এবং ভয়াবহ কিছু একটা করে ফেলবেন। সূত্রঃ বিডিপ্রতিদিন।

 

আমি যে সময়টার কথা বললাম সেটা সম্ভবত ২০১০ সালের প্রথম দিকের ঘটনা। তখনো শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, গ্রামীণ ব্যাংক এবং কুইক রেন্টালের বদনামিগুলো শুরু হয়নি। তখনো জাতি জানতে পারেনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অন্য মন্ত্রীদের সঙ্গে আপনার পারস্পরিক সম্পর্কের কথা। তখনো বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক খারাপ হয়নি এবং আপনার মুখ দিয়ে বোগাস বা রাবিশ শব্দ বের হওয়া শুরু হয়নি- অথচ ঠিক ওই সময়ে আমার কচি মনে কেন জানি নানান অশনি সংকেত আঘাত করেছিল আপনার অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে সময় থেকেই আমার পোড়া মুখ দিয়ে দু-চারটি বেফাঁস কথা সবে বের হওয়া শুরু করেছিল। এসব নিয়ে আপনি ছিলেন আমার প্রতি যারপরনাই বিরক্ত। নির্বোধ হওয়ার কারণে আমি ওসব বুঝতাম না। কিন্তু সংসদীয় দলের একটি বৈঠকে সুযোগ পেয়ে আপনি যখন আমাকে একহাত দেখে নিলেন তখন আমি বুঝলাম, কত ধানে কত চাল।

আপনার হয়তো মনে থাকতে পারে সেদিনকার ঘটনাটির কথা। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিখ্যাত দৌড়ের কাহিনীটি গল্পাকারে চ্যানেল আই তৃতীয় মাত্রায় বলার কারণে আমি ছিলাম ভয়ানক তোপের মুখে। আর আপনি তখন প্রথম সারিতে বসে হালকা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ঝিমুচ্ছিলেন। আপনার পাশে বসা আমাদের চিরকুমারী বোন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও আপনাকে সগৌরবে অনুকরণ করে মুদিত নয়নে বার বার সামনে-পেছনে, ডানে-বাঁয়ে ন্যুয়ে পড়ছিলেন। এমন সময় আপনারা দুজনই হয়তো শুনলেন, গোলাম মাওলা রনিকে কেউ কেউ কঠোর ভাষায় সমালোচনা করছেন। আপনাদের মুদিত অাঁখিতে অগি্ন গোলকের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুজন মহান মন্ত্রী বলতে গেলে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলেন। বোনটি আমার কি বলল তা আজ আর মনে নেই। তবে দাদু ভাইয়ের কথা! সেকি ভোলা যায়! তিনি বললেন- ও একটা পণ্ডিত! ও টকশোতে আমাকে নিয়েও আপত্তিকর কথা বলেছে। ও নাকি আমাকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমিতে দেখেছে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গুনতে! হাউ ফানি! তখন তো আমি ওর নামই শুনিনি। ও আমাকে চিনল কি করে?

বিশ্বাস করুন, সেদিনের ঘটনার পর থেকে আজ অবধি আমি আপনার বিষয়ে কোনো কিছু প্রকাশ্য মন্তব্য করতে গিয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে আসছি। কিন্তু ইদানীংকালে অনেক কিছুই ধৈর্য এবং সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। মনে হচ্ছে, জাতির স্বার্থে লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আপনাকে কিছু কথা বলা উচিত। সম্মানিত দাদু ভাই, আপনি যদি আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং পক্ষে বা বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া দেখান তবে এ জাতি উপকৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস। আপনার সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন নিম্নরূপ।

১। আপনার বিশ্বাস, আস্থা এবং স্বাভাবিক চারিত্রিক দৃঢ়তা না থাকার কারণে দেশে কয়েকটি মারাত্দক জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার বার বার সমন্বয় করতে গিয়ে আপনি পুরো বিষয়টিকে লেজে-গোবরে করে ফেলেছেন। একই ঘটনা করেছেন হলমার্ক এবং ডেসটিনির ক্ষেত্রে। যে সত্য আপনি জানতেন এবং যে সম্ভাব্য পরিণতি আপনি অাঁচ করেছিলেন তা যদি দৃঢ়তার সঙ্গে ধারণ করতে পারতেন তবে কেলেঙ্কারির ক্ষয়ক্ষতি আরও অনেক অনেক কম হতো। শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে আপনার অসহায় আকুতি- ওরা অনেক শক্তিশালী কিংবা শেয়ারমার্কেট বুঝি না ইত্যাদি কথামালা ইবলিশদের নতুন নতুন অপরাধ সংঘটনে উৎসাহিত করেছে।

২। আমার সর্বদা মনে হয়, টাকা-পয়সার আয়-রোজগার এবং হিসাব-নিকাশের ব্যাপারে আপনি ইংরেজ কবি শেলির মতোই বড্ড বেখেয়ালি। আমি নিশ্চিত, গত ৮০ বছর ধরে বিশেষ করে দাদির সঙ্গে আপনার শাদি মোবারকের পর থেকে অর্থ বিষয়ে বেখেয়ালিপনার অভিযোগ শুনতে শুনতে আপনার কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। আপনি হয়তো কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে আমার কান মলে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন- তা ইচড়ে পাকা নাতি! আমার ঘরের খবর তুমি জানলে কেমনে! উত্তর ভারি সোজা। আমি এ দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্কের ধরন দেখেই বুঝতে পারি- ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা, ভোগ-বিলাস, আয়-উন্নতি, বাড়ি-গাড়ি এবং সুন্দরী নারী সম্পর্কে আপনার মনোভাব-

কেন জানি মনে হয়, শেয়ারমার্কেটের মতো আপনি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ভালো করে কিছু জানেন না। কারা ফটকাবাজ, কারা ধান্দাবাজ কিংবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে কারা লুটেরা, প্রতারক, ডাকাত এবং চোরের স্বভাবযুক্ত তা যদি ভালোভাবে না বোঝেন এবং না চিনেন- তবে সৎ মানুষদের আলাদা করবেন কীভাবে? আপনার এই অপারগতার কারণে দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন সূত্রটি এ দেশের আর্থিক সেক্টরে অকার্যকর অবস্থায় আছে। গত সাত বছরে বড় কোনো শিল্প কল-কারখানা গড়ে ওঠেনি। দেশের প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো হাত গুটিয়ে বসে আছে। হয় তারা অভিমানী হয়ে নতুন বিনিয়োগে হাত দিচ্ছে না, নয়তো আপনার দফতর ও উপদফতরের খারাপ মানুষদের রাজি-খুশি করিয়ে অর্থের সংস্থান করতে পারছে না। আমদানি বাণিজ্যের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে নব্য লুটেরাদের কাঁচা পয়সার দাপটের কারণে।

৩। আপনার ব্যর্থতার ভয়াবহ প্রথম স্থানটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। আর দ্বিতীয়টি হলো সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রথম দিন থেকেই দেশবাসী বুঝতে শিখেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রীকে গুরুত্ব বা পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছে না। আমি দেশবাসীর সঙ্গে একমত। আমার মনে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং আপনি দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। আপনি আপনার মতো মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন আর তিনি চালাচ্ছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিনি আপনাকে পাত্তা দিতে যাবেনইবা কেন? আপনি কি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন কিংবা তার নিয়োগ বাতিলের ক্ষমতা রাখেন? তিনি দৈনিক যতবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন, ততবার কথা বলার সুযোগ আপনিও পান না বলে বাজারে কানাঘুষা চলে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর তো ইদানীং অনেক বড় ব্যাপার। আপনার ক্ষমতার আওতা কি সেখানকার ডিপুটি গভর্নর বা নির্বাহী পরিচালকদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখে? শুনেছি সেখানে অদ্ভুত এক ডিপুটি গভর্নর আছেন, যিনি সরকারি দলের পাণ্ডা পরিচয় দিতেই গর্ব অনুভব করেন। তার লেখাপড়ার বাহারি যোগ্যতা নাকি তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদাকে আলোকময় করেছে। অর্থাৎ শিক্ষাজীবনের একাধিক তৃতীয় শ্রেণি নিয়ে বোধগম্য কারণে অতবড় পদ দখল করতে পেরেছেন। ওই লোকটির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সব শিডিউল ব্যাংকের মধ্যকার সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে। লোকটির দ্বারা অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হননি এমন কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বা প্রধান নির্বাহীকে আপনি খুঁজে পাবেন না। সবাই তাকে যমের মতো ভয় পায়। দুঃখিত, যম হবে না। কারণ যম তো দেখা যায় না, কিন্তু তাকে দেখা যায়। আমার মনে হয়, লোকজন তাকে মানুষ নয় এমন কিছুর মতো ভয় করে এবং দংশিত হওয়ার শঙ্কায় এড়িয়ে চলে।

অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং শিডিউল ব্যাংকগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক কিন্তু এমন ছিল না। আপনার পূর্বসূরি প্রয়াত সাইফুর রহমানের সময় মন্ত্রীর কথা শুনলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবার হাঁটুতে কাঁপন ধরত। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশ ব্যাংক পরিদর্শনে যেতেন। ডিপুটি গভর্নর পর্যায়ের লোকজনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন- এই যোগ্যতা নিয়ে ডিপুটি গভর্নর হলে কি করে? তোমারে কে বানাইছে? কিংবা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবের কথাই চিন্তা করুন না একবার! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা সিএসপি কর্মকর্তা ড. ফরাসউদ্দিনের মতো লোককে গভর্নরের চেয়ারে বসিয়ে তিনি কত সুন্দরভাবেই না পাঁচটি স্বর্ণালি অর্থবছর জাতিকে উপভোগ করিয়ে গেছেন। আহা! সেদিনের কথা মনে হলে, আজও আমার অন্তর খুশিতে নেচে ওঠে। আর বর্তমান অবস্থা দেখে বার বার মনে হয়, আমি উন্মাদ হয়ে যাইনি তো! এসব কথা মনে হলেই আমি নিজের গালে চিমটি মারি। সারা শরীরে নজর বুলিয়ে পোশাক-পরিচ্ছদ ঠিক আছে কিনা তা পরখ করি এবং এক সময় আপন মনে বলে উঠি- মহান আল্লাহ! আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এখনো সুস্থ আছি, পাগল হয়ে যাইনি।

সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর কথা আর কি বলব? একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় থেকে এ জাতিকে রক্ষা করতে পারবে না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় যেদিন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ লোকদের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হলো সেদিন সর্বনাশের প্রথম পেরেকটি মারা হয়েছিল। এর পর কতগুলো বেসরকারি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়ে পুরো ব্যাংকিং সেক্টরে স্বীকৃত চোর, বাটপার এবং লুটেরাদের স্থায়ী আবাস গড়ে দেওয়া হলো। এখন পতনটা কেবল সময়ের ব্যাপার। নিশ্চয়ই আপনার বিয়ারিংস ব্যাংকের কথা মনে আছে কিংবা মনে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পূর্ব ঘটনা। আপনার এ কথাও হয়তো মনে আছে, বাস্তিল দুর্গের পতনের মূল কারণ কিন্তু ছিল বাজেট ঘাটতি!

৪। ইদানীং আপনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায়ই রেগে যাচ্ছেন। আর আপনার রাগের শিকার হচ্ছেন দুর্বলচিত্তের ভদ্রলোকেরা। এই সেই দিন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আকরাম সাহেবের সঙ্গে কি কাণ্ডটাই না করে বসলেন। আপনার বীরত্ব দেখে খুশি হতাম, পা ছুঁয়ে সালাম করতাম- যদি আপনি আর্থিক সেক্টরের দুর্বৃত্তদের সঙ্গে এমন করে মেজাজ দেখাতে পারতেন! যদি সাহস থাকে তবে শেয়ার কেলেঙ্কারি এবং ব্যাংক পাড়ার কেলেঙ্কারির হোতা ইবলিশদের পাঞ্জাবিতে একটু স্পর্শ করে আসুন তো! পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে আপনার দূরত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতাকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পসহ বৈদেশিক ঋণের সমন্বয়ে নানা রকম নিত্য-নতুন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।

৫। দল এবং সরকারে আপনি নিতান্ত বন্ধুহীন একজন মানুষ। আমার পাঁচ বছরের এমপিকালীন আমি দলের মধ্যে এবং সরকারে আপনার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুরও সন্ধান পাইনি। কেবল দলীয় প্রধান এবং সরকারপ্রধানের করুণাকে সম্বল করে জীবনসায়াহ্নে এসে আপনি যে ভার বহনের চেষ্টা করছেন, তা কিন্তু আপনার জন্য খুব বেশি ভারী হয়ে গেছে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলানোর কোনো প্রয়োজন কিংবা তাগিদ আপনাকে পীড়া দেয় না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনার কোনো আত্দিক বন্ধন যেমন নেই তেমনি নেই কোনো শত্রুতা। রাজনীতিতে আপনি নির্মোহ একজন মানুষ। কারণ আপনার কোনো রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী আপনাকে দিবানিশি জ্বালাতন করে না- তাকে আপনার প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়ার জন্য। ফলে দলীয় রাজনীতির শৃঙ্খলে থাকার প্রয়োজনীয়তা আপনি অনুভব করেন না। আর তাই তো আপনার নিজের অজান্তে সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে একের পর এক অনাসৃষ্টি।

আপনার বয়স আপনাকে অনেক কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে। শিল্প, বাণিজ্য এবং প্রথাগত দলীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে আপনার অনভিজ্ঞতার কারণে আপনি আপন-পর ভেদাভেদ করতে পারছেন না- তাই শত্রু হয়ে যাচ্ছে বন্ধু আর বন্ধু হয়ে পড়ছে শত্রু। আপনি যোগ্যতমকে রাখছেন দূরে সরিয়ে আর অযোগ্যরা চলে আসছে সামনে। দুর্নীতি সম্পর্কে আপনার সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চিহ্নিত দুর্নীতিবাজরা আপনাকে অন্ধ মনে করে আপনার চোখের সামনে উদোম হয়ে উল্লাস নৃত্য করছে।

আমার প্রিয় দাদু ভাই, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। একদিন আমি সংসদে বসে আপনার জন্য কেঁদেছিলাম। সহকর্মীদের সমালোচনায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে আপনি দাঁড়িয়ে স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন- মাননীয় স্পিকার! আমার মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। একজন সম্মানিত বয়স্ক, শিক্ষিত এবং সৎ মানুষ পঙ্কিলময় রাজনৈতিক ফাঁদে আটকা পড়ে বোবাকান্না কাঁদছে, এ দৃশ্য দেখে আমি স্থির থাকতে পারিনি। দয়া করে আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হন এবং ভাবুন- আপনাকে এত কথা বলে আমার কি লাভ? আমার কি কোনো স্বার্থ আপনার কাছে ছিল কোনো কালে বা আছে বর্তমানে? আমি তো কোনো দিন আপনার দফতরে যাইনি এবং আমাদের কোনো কালে সরাসরি কথাও হয়নি। তবুও আমি আপনার শুভার্থী। এত বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের ধারক একজন সফল মানুষ জীবনসায়াহ্নে এসে পরাজিত হবেন, মানুষের অভিশাপ নিয়ে বিদায় হবেন কিংবা আরও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হবেন- এমনটি ভাবতেই বুকের মধ্যে আপনার জন্য কেমন জানি একটা মায়া তৈরি হয়। প্লিজ দাদু ভাই! আপনি রাগ করবেন না।

লেখক : রাজনীতিক