বিশ্বব্যাপী দিন দিন বাড়ছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পেশার চাহিদা। তাই উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো থেকে নার্স নিয়োগ দিচ্ছে বিভিন্ন উন্নত দেশ। দেশেও চাহিদা রয়েছে দক্ষ নার্সের। অন্যদিকে দেশে দিন দিন বাড়ছে নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা। সেখান থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছেন। তবে তাদের সিংহভাগই বেকার থেকে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশ-বিদেশে কাজের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নার্সদের বেকার থাকার পেছনে গুণগত শিক্ষার ঘাটতি, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব ও অদক্ষতা, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা ও নীতিনির্ধারকদের নজরদারির অভাব বহুলাংশে দায়ী। এছাড়া তাদের মতে, দেশে কম পদসংখ্যা, বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় নিম্ন বেতন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে দেরি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ খাত। যার কারণে বিএসসি ইন নার্সিং এবং ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি ডিগ্রি নেয়ার পরও অনেক বছর শিক্ষার্থীদের বেকার বসে থাকতে হয়।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের তথ্যানুসারে, দেশে নার্সিং প্রতিষ্ঠান মোট ৪০৮টি। এর মধ্যে সরকারি ৭০, বেসরকারি ৩৮৩ এবং স্বায়ত্তশাসিত আটটি। নার্সিং, মিডওয়াইফারি ও বিএসসিতে প্রতি বছর ৩৬ হাজার ৪০০টি আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি এবং বিএসসি ইন নার্সিংয়ে আসন সংখ্যা যথাক্রমে ২০ হাজার ৭১৫ ও ৯ হাজার ৯০০। এত নার্সিং ইনস্টিটিউট ও শিক্ষার্থী থাকা সত্ত্বেও দেশে মোট নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭৭ জন। এর মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার ৩৫৮ জন সরকারি পর্যায়ে কাজ করছেন। অন্যদের একাংশ কাজ করছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বাকিরা বেকার।
সর্বশেষ সরকারি পর্যায়ে নার্স নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় ২০২৩ সালে। যেটির ফল প্রকাশ করা হয় ২০২৫ সালে। সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ফারজানা আক্তার বলেন, ‘ইদানীং নার্সিং ইনস্টিটিউট বেড়ে যাওয়ায় প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী পাস করে বের হচ্ছেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই ভালো কাজের সুযোগ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ খুবই সামান্য বেতনে কাজ করছেন। যার কারণে পাস করা বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই হতাশায় ভুগছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সেবার ক্ষেত্রে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকা দরকার। বাংলাদেশে এ অনুপাত ঠিক নেই। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, জনসংখ্যার হিসেবে দেশে ১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ জন চিকিৎসক, ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ নার্স এবং ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদের অভাব, নিয়মিত নিয়োগ ও পদোন্নতি না থাকায় নার্সদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। বেশির ভাগ সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার বাইরে অবস্থিত বেশির ভাগ নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে আছে বলে জানান নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. মমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যে নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলো আছে তার সবগুলোর মান এক নয়। এসব ইনস্টিটিউটে যে ধরনের সুবিধা দরকার তা আসলে নেই। শিক্ষক সংকটও রয়েছে। যার কারণে যারা ভর্তি হন তাদের মানসম্মত শিক্ষা দেয়া যায় না। আবার ঢাকাকেন্দ্রিক নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলো সুযোগ-সুবিধা একটু বেশি পাচ্ছে। ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ছেন। পাশাপাশি যত সংখ্যক নার্স প্রতি বছর পাস করে বের হন তত পদও নেই। যার কারণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তাদের নিয়োগ দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের পাশাপাশি বিদেশেও নার্সিং পেশার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কুয়েত, সৌদি আরব, জাপান ইত্যাদি দেশ প্রতি বছর অন্যান্য দেশ থেকে নার্স নিয়োগ করছে। সৌদি আরবে মোট নার্সের ৩০ শতাংশ বিদেশী। যাদের বেশির ভাগ ভারতীয়, নেপালি ও ফিলিপিনো। নেপালে প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার নার্স রয়েছেন, যাদের এক-তৃতীয়াংশই বিদেশে কাজ করছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে থেকে বিদেশে কাজ করতে যাওয়া নার্সের সংখ্যা অতি নগণ্য।
নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফি অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, সরকারি পর্যায়ে কর্মরত মাত্র ৩২৭ জন নার্স লিয়েনে বিদেশে কাজ করছেন। এর মধ্যে কুয়েতে ২২২ জন, সৌদি আরবে ৮৫, যুক্তরাষ্ট্রে আটজন এবং অল্প সংখ্যক ইতালি, লিবিয়া, ফিনল্যান্ড ও ডেনমার্কে কর্মরত রয়েছেন। কিছু সংখ্যক নার্স বেসরকারি পর্যায়ে দেশের বাইরে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত চার বছরে বেসরকারিভাবে চাকরিরত ৬০০ জন দেশের বাইরে চাকরিতে গেছেন।
অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে সরকারি চাকরিরত মোট ৪৬০ জন নার্স বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক নার্স লিয়েন শেষে দেশে ফিরে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ২৫০ জন নার্স দেশের বাইরে চাকরির জন্য যান।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নার্সদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হলো ভাষাগত দক্ষতার অভাব। এছাড়া পাস করার পরও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে ডিপ্লোমা ও বিএসসি ডিগ্রিধারী নার্সরা বিশ্ববাজারে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারছেন না।
কুমিল্লা ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন নার্সিং ইনস্টিটিউটের প্রভাষক মো. রফিকুল আলম জুয়েল বলেন, ‘একজন নার্সের ব্যবহারিক বিষয়গুলোর ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা জরুরি। শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গের কাজ সম্পর্কে জানা উচিত। ডিপ্লোমা বা বিএসসি করার পর আন্তর্জাতিক মানের কিছু প্রশিক্ষণের দরকার হয়। একজন নার্স পাস করে বের হওয়ার পর যদি বেসিক কোর্সগুলো সম্পর্কে অবগত না থাকেন, তাহলে তিনি দেশেও যেমন কাজে লাগবেন না, বিদেশেও কাজের সুযোগ পাবেন না। নার্সিং পাস করার পর ভাষাগত ও অন্যান্য দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সরকারি পর্যায়ে আরো কিছু প্রশিক্ষণ বাড়ানো দরকার। তাহলে দেশের নার্সরা আন্তর্জাতিক বাজারেও তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারবেন।’
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের নার্সদের প্রশিক্ষণ ও সেবার মান দুটোই নিম্ন। যার কারণে দেশে যারা তাদের থেকে সেবা নিয়ে থাকেন, তারাও যেমন সন্তুষ্ট থাকেন না, তেমনি তারা বিদেশেও তেমন কাজের সুযোগ পান না। আমাদের দেশ থেকে যে ডিগ্রি দেয়া হয় সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হতে হবে। এছাড়া বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাষা একটি বাধা। যোগাযোগ দক্ষতা কম থাকার কারণে বাইরের দেশে তারা যাওয়ার সুযোগ পান না।’