Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গাদ্দাফি লিবিয়াকে ধনী বানিয়েছিলেন : আমেরিকা তাকে ফকির বানিয়েছে

মোবায়েদুর রহমান : আমেরিকা যখন কোন ভূখন্ডের ওপর হাত ফেলে তখন আর সেটি হাত থাকে না। সেটি হয় থাবা। সেই ভূখন্ডে আমেরিকা থাবা বিস্তার করে। কিন্তু মার্কিন থাবা সাধারণত হয় কালো থাবা। যে থাবা যত ভয়াল ও রোম হর্ষক হয় সেই থাবাকে ভারতের এক বাঙালি সাহিত্যিক নাম দিয়েছেন ‘আগ্নেয় থাবা’। লিবিয়ার ক্ষেত্রে এই কথা শতকরা একশত ভাগ প্রযোজ্য।
এই দেশটি একদিন সোনার দেশ ছিল। সেটি বেশি দিন আগের কথা নয়। এই তো ২০১১-১২ সালের কথা। তখন ন্যাটো বাহিনী লিবিয়ায় হামলা চালায়, দেশটিকে তছনছ করে দেয়। ১৯৬৭ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি লিবিয়ার ক্ষমতা দখলের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে একটি গরিব দেশই পেয়েছিলেন। আর খুন হওয়ার সময় লিবিয়াকে রেখে যান আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী জাতি হিসেবে। গাদ্দাফি মারা যাওয়ার সময় আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে মাথাপিছু আয় এবং জীবনমানের দিক দিয়ে লিবিয়া ছিল এক নম্বরে। এ দেশটিতে ইউরোপের অন্যতম উন্নত দেশ নেদারল্যান্ডসের চেয়েও কম মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। অথচ এই লিবিয়া আফ্রিকা মহাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং পৃথিবীতে সপ্তদশ বৃহত্তম রাষ্ট্র। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির জনসংখ্যা ১০ লাখ। তেল সম্পদ মজুদের দিক দিয়ে লিবিয়া বিশ্বের ১০তম বৃহত্তম তেল সম্পদের দেশ।

দেশটির উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূবে মিসর, দক্ষিণ-পূর্বে সুদান, দক্ষিণে চাদ ও নাইজার এবং পশ্চিমে আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়া। ১৯৫১ সালে লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। তখন তার নাম হয় সংযুক্ত লিবীয় কিংডম। ১৯৬৩ সালে এই নাম পরিবর্তন করে হয় কিংডম অব লিবিয়া। ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর তরুণ কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি দেশটির রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। দেশটির নতুন নাম হয় লিবীয় আরব প্রজাতন্ত্র। পরবর্তীতে এর নাম হয় সমাজতান্ত্রিক আরব প্রজাতন্ত্র লিবিয়া।

chardike-ad

আমর ইবনুল আছের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী এই ভূখন্ড দখল করে। ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাইজানটাইনদের নিকট থেকে ত্রিপোলি দখল করেন আব্দুল্লাহ ইবনে সাদ। এখানকার অধিবাসীরা ইসলামকে তাদের ধর্ম হিসেবে কবুল করেন। তবে তারা আরবদের রাজনৈতিক প্রভূত্ব প্রতিহত করে। পরবর্তী বেশ কয়েক দশক ধরে লিবিয়ার অধিবাসীরা দামেস্কের উমাইয়া খলিফার শাসনাধীনে ছিলেন। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খলিফা উমাইয়া শাসন উৎখাত করেন। ফলে লিবিয়া দামেস্কের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাগদাদের শাসনাধীনে চলে যায়। যখন খলিফা হারুন অর রশিদ ইব্রাহীম ইবনুল আগলাগকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। তখন লিবিয়া যথেষ্ট স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। এরপর সময়ের আবর্তনে লিবিয়া ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। এরপর লিবিয়া চলে যায় রোমকদের শাসনাধীনে।

আগেই বলা হয়েছে যে ১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই স্বাধীনতার নায়ক ছিলেন বাদশাহ ইদ্রিস। ১৯৫৯ সালে লিবিয়ায় সর্বপ্রথম তেল সম্পদ আবিষ্কৃত হয়। এই তেল বিক্রি লিবিয়ার ভাগ্য রাতারাতি বদলে দেয়। পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র রাতারাতি পৃথিবীর অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। তেল বিক্রির অর্থ বেশ কিছুসংখ্যক মানুষের ভাগ্য বদলে দিলেও একশ্রেণীর মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তারা অভিযোগ তোলে যে, রাষ্ট্রের এই সম্পদ ধীরে ধীরে বাদশাহ ইদ্রিস এবং তার পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ১৯৬৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ২৭ বছর বয়স্ক তরুণ সামরিক অফিসার কর্নেল মোয়াম্মার গাদ্দাফি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশাহ ইদ্রিসকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। এই সামরিক অভ্যুত্থানের নাম দেওয়া হয় আল-ফাতাহ বিপ্লব। সরকারের বক্তৃতা এবং বিবৃতিতে গাদ্দাফিকে বিপ্লবের ভাই এবং নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৭ সালের ২ মার্চ লিবিয়াকে সরকারিভাবে মহান সমাজতান্ত্রিক আরব প্রজাতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কর্নেল গাদ্দাফি ঘোষণা করেন যে তিনি জনগণের কমিটির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন।

দুই
কর্নেল গাদ্দাফি তার রাষ্ট্র, অর্থনীতিও সমাজ ব্যবস্থার রূপরেখা বিধৃত করেছেন তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী পুস্তিকা ‘দি গ্রীন বুকে’। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত এই পুস্তিকা মোতাবেক আলোচ্য গণ কমিটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে ডিবেটের ব্যবস্থা করে। এই গণ কমিটির সদস্য সংখ্যা ২০০০। এই ডিবেটে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পাঠানো হয়। সেখানে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯৭৭ সাল থেকে লিবিয়ার মাথাপিছু আয় অবিশ্বাস্য গতিতে বাড়তে থাকে। এই বছর মাথাপিছু আয় হয় ১১ হাজার মার্কিন ডলার। মানব উন্নয়ন সূচকে লিবিয়া আফ্রিকার শীর্ষে উঠে আসে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়। এতো কিছু করার জন্য লিবিয়াকে বৈদেশিক সাহায্যের জন্য হাত পাততে হয়নি। কর্নেল গাদ্দাফি তার জনগণের ঘাড়ে কোন ঋণের বোঝা চাপাননি। তার আমলে ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে বিনা সুদে।

২০১১ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপের পর লিবিয়া এখন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিপর্যস্ত অবস্থায় পরিণত হয়েছে তার অর্থনীতি। সেখানে সত্যিকারের কোনো সরকার ব্যবস্থা নেই। যে যার মতো করে অধিকৃত জায়গা শাসন করছেন। আর তেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশ রূপ নিয়েছে কসাইখানায়। লিবিয়াতে আগে থেকেই মিলিশিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ছিল। স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপজাতিগত, ইসলামপন্থী ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে গাদ্দাফি ভালোভাবেই দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ন্যাটো হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ায় দুটি যুদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে যাদের নিজস্ব প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট এবং সামরিক বাহিনী রয়েছে।
সেখানে দুটি সরকার গঠিত হয়েছে। এদের এক পক্ষ ইসলামী মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সমন্বয়ে রাজধানী ত্রিপোলিসহ কয়েকটি শহর নিয়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সরকার গঠন করেছে। এই সরকারের নির্বাচন হয়েছে গেল গ্রীষ্মে। অন্যদিকে ইসলামী মিলিশিয়াদের বিরোধী পক্ষ দেশের পূর্বাঞ্চলে সরকার গঠন করেছে। গাদ্দাফি প্রশাসনের পতনের পর লিবিয়ায় একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের দূতাবাস গুছিয়েনিয়েছে। দেশের দক্ষিণ অঞ্চল পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে। আর উত্তরাঞ্চল হয়েছে মানব পাচারের সিল্করুট।

লিবিয়ার সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে মিসর, আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়া। এসব কারণে বেড়েছে ধর্ষণ, খুন ও অত্যাচারের পরিমাণ যা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের ছবিকে স্পষ্ট করেছে। দুটি অকেজো সরকারের উপর বিরক্ত যুক্তরাষ্ট্র এখন তৃতীয় পক্ষকে সহায়তা করছে।
গাদ্দাফির পতনের পর পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় লিবিয়ার সমস্ত তেল সম্পদ করায়ত্ত করেছে পশ্চিমারা। ৪০ বছরের বেশি সময় গাদ্দাফি অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে বিকশিত করে সমাজের উন্নতির জন্য জাতীয় সম্পদ তেলকে প্রত্যেক নাগরিকের কল্যাণে ব্যবহার করেছেন। গাদ্দাফির শাসনামলে তার নাগরিকরা শুধু বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবাই পাননি, পেয়েছেন বিনামূল্যে শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও বিনা সুদে ঋণ। ন্যাটোকে ধন্যবাদ, তাদের হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ পুরোপুরি ভেঙে গেছে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়েছে এবং রাজধানী ত্রিপোলিসহ সারাদেশে সব ধরনের অপরাধ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ন্যাটো হস্তক্ষেপের পর লিবিয়ার জনগণের যে অংশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারা হলো নারী। শিক্ষা, চাকরি, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির মালিকানা এবং উপার্জন সবকিছুতেই আরব বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশের নারীর চেয়ে বেশি অধিকার ভোগ করতো গাদ্দাফি আমলে লিবিয়ার নারীরা। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করায় জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ভূয়সী প্রশংসা করেছিল গাদ্দাফির।
১৯৯১ সালে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ তাদের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ‘জেনারেল হিফতিয়ার এবং অন্তত ৬০০ সৈন্যকে গেরিলাসহ সব ধরনের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সিআইএ। রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসনের সহায়তায় তারা দ্রুতই গাদ্দাফি সরকারকে উৎখাত করতে যাচ্ছে’। হিফতারের বাহিনী দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজী দখলে নিতে আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট আনসার আল শরীয়াহ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

১৯৬৯ সালে গাদ্দাফি যখন ক্ষমতা দখল করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর সংখ্যা ছিল খুব কম। আর এখন লিবিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অর্ধেকই নারী। ১৯৭০ সালে নারী-পুরষের জন্য সমান মজুরির আইন পাস করেছিলেন গাদ্দাফি। কিন্তু নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ শাসকরা নারী অধিকারকে দিন দিন দমিয়ে ফেলছে। তিন বছর আগেই এক ঘোষণায় ন্যাটো বলেছিল, তাদের ইতিহাসে লিবিয়া অভিযানই সবচেয়ে সফল। কিন্তু সত্য হলো, পশ্চিমা হস্তক্ষেপ কোথাও কোনো উন্নতি করতে পারেনি, সেটা লিবিয়া, ইরাক এবং সিরিয়া যেখানেই হোক।
পশ্চিমা হস্তক্ষেপের আগে তিনটি দেশ (লিবিয়া, ইরাক ও সিরিয়া) মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে সেকুল্যার দেশ ছিল। আর লিবিয়া তো পুরো আফ্রিকার মধ্যে জীবনমান এবং নারী অধিকারের শীর্ষে ছিল। মধ্যপ্রাচ্যে এক দশকের সামরিক অভিযান মার্কিন নাগরিকদের ট্রিলিয়ন ডলার দেনা বানিয়েছে। তবে ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে মার্কিনিদের একটা অংশ লাভবান হয়েছে। সে অংশটা মার্কিন সামরিক শিল্প। নতুন সামরিক ঘাঁটি মানেই মার্কিন অভিজাত সামরিক বাহিনীর জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, ইরাকে বোমা মারার জন্য মার্কিনিরা ঘাঁটি গেড়েছে কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান এবং সৌদি আরবে। এভাবে আমেরিকা যেখানেই গেছে সেখানেই তার সর্বনাশ ঘটিয়েছে।