বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়ার ৪০ বছর পুর্তি উপলক্ষে জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত  ব্যারিস্টার হারুন উর রশীদের ইংরেজিতে লেখা প্রবন্ধ বাংলা টেলিগ্রাফের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মো. মহিবুল্লাহ
২০১২ সালের ১২ই মে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ৪০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৭২ সালের এই দিনে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে। ঢাকায় কোরিয়ার কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের মার্চে এবং বাংলাদেশ কোরিয়ায় হাইকমিশন স্থাপন করে ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে।

দক্ষিণ কোরিয়া ইতোমধ্যেই এ অঞ্চলের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। গত দুই দশকে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে অবিশ্বাস্য গতিতে। ২০১০ সালের হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ায় মাথাপিছু আয় ২৮,০০০ ইউএস ডলার।

chardike-ad

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্ত অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছে। ২০১০ সালের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক হওয়ার পাশাপাশি গেলো বছরের মার্চে দেশটি পরমাণু নিরাপত্তা বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিভিন্ন দেশের পঞ্চাশ জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, জাতিসংঘের মহাসচিব পদে দক্ষিণ কোরিয়ান বান কি মুন দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন কোরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ড. জিম ইয়ং কিম।

বাংলাদেশ-দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্ক পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত সুদৃঢ় হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া বরাবরই বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে এবং কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বহু স্থাপনা নির্মাণে দক্ষতার সাথে ভূমিকা রেখে চলেছে। দু’দেশের বেসরকারি খাতগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার করছে। বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ান বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা দিনদিন বেড়েই চলেছে।

১৯৭৩ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক বিনিময়, বিনিয়োগের বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা প্রদান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করে আসছে। দুদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুসংহত করতে দক্ষিণ কোরীয় প্রধানমন্ত্রীগণ ১৯৯৪ ও ২০০২ সালে মোট দুবার বাংলাদেশ সফর করেছেন।

২০০৭ সালের জুনে বাংলাদেশ কোরিয়ার সাথে জনশক্তি রপ্তানি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক কর্মসংস্থান অনুমতি ব্যবস্থা (ইপিএস) স্বাক্ষর করে যার আওতায় দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশ এবং আরো ১৪টি দেশ থেকে ৫০,০০০ দক্ষ শ্রমিক নিচ্ছে। নির্মাণ, উৎপাদন, সেবা, কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি শিল্প এই কয়টি বিভাগে প্রায় ১০,০০০ দক্ষ বাংলাদেশী শ্রমিক কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও জুতা উৎপাদন কারখানাগুলোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করে চলেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (বেপজা) যৌথ উদ্যোগে বেশ কিছু শিল্প স্থাপিত হয়েছে এবং কোরিয়ার পক্ষ থেকে ভবিষ্যতেও বেপজায় বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

২০০৮ সাল পর্যন্ত কোরিয়ায় পন্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত যা ২০০৯ সালে নতুন ২৫৩টি পন্যসহ ৮০ শতাংশ ও ২০১০ সালে ৮৫ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশ কোরিয়ায় কাঁচা পাট, পাটজাত পন্য, পাটের সুতা, নিউজপ্রিন্ট কাগজ, চা, চামড়াজাত পন্য, তামাক ও সার রপ্তানি করে ১৪৮.২ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে। এসময় দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশে ৮৩৬.৩৬ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পন্য রপ্তানি করে যার মধ্যে রয়েছে রাসায়নিক দ্রব্য, ডায়িং কাঁচামাল, চামড়া প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতি, ফারমাসিউটিক্যালস পন্য, লোহা ও স্টীল, বৈদ্যুতিক মালামাল ও মোটর পার্টস। হালকা ইলেক্ট্রনিক পন্য ও কম্পিউটারের পাশাপাশি কোরিয়ান গাড়িও বাংলাদেশের বাজারে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ান বেসরকারি বিনিয়োগ ২০১০ সালে ৬৯৮ মিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে যা এক বিলিয়ন ইউএস ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের মে মাসে এক সরকারি সফরে সিউল যান যা ছিল বিগত ১৫ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ায় কোন বাংলাদেশী প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র সফর। এ সময় উভয় দেশ বেশ কয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লী মুং-বাক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাঁর দেশের সমৃদ্ধির অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো এবং জাহাজশিল্প, নির্মাণ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কারিগরি সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। ২০১৩ সালকে উভয় দেশ কোরিয়া-বাংলাদেশ বছর বলেও ঘোষণা দিয়েছে।

২০১১ সালের অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়ান হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ও দ্যাউ ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন আশুগঞ্জে ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এদিকে কোরিয়ান ও মার্কিন দুটি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার সাথে যৌথ উদ্যোগে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কোরিয়ান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (কইকা) কুমিল্লায় তাদের গৃহীত একটি উন্নয়ন প্রকল্পে ৩.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে যা কইকা  ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড) যৌথভাবে বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি ৬৫,০০০ কৃষকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

২০১২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ সচিবালয়ে কইকার সহায়তায় প্রস্তাবিত “স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়ন” প্রকল্প হস্তান্তর করা হয়। এ প্রকল্পের আওতায় কইকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ে ই-ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার, ২৪টি ডেস্কটপ ও ৬টি ল্যাপটপ কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তিগত অন্যান্য কারিগরি সহায়তাসহ একটি আইসিটি প্রশিক্ষন কক্ষ স্থাপন করেছে। এর আগে কইকা সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশ-কোরিয়া সম্পর্ক উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করছে। ২০০৯ সালে কোরিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও কোরিয়ান ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১১ জন বাংলাদেশী শিল্পীর শতাধিক চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয় কোরিয়ান ফাউন্ডেশন কালচারাল সেন্টারে। দক্ষিণ কোরীয় নৃত্য শিল্পীদের একটি দল প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশ সফর করছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশে কোরিয়ান দূতাবাসের উদ্যোগে একটি কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশ ও কোরিয়ার সম্পর্কের ভিত্তিটি এখন যথেষ্টই মজবুত এবং আগামী দিনগুলোতে উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে তা আরও সুসংহত হবে এমনটাই প্রত্যাশা।