শাবান মাস হলো আরবি বছরের অষ্টম এবং রমজান মাসের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক মাস। এ মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটি অতিশয় মর্যাদাপূর্ণ রাত হিসেবে উদযাপিত হয়ে থাকে। এ রাতটি ‘শবেবরাত’ হিসেবেই অধিক পরিচিত।
শবেবরাতের পরিচয়: ‘শব’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ রাত। আর ‘বারাত’ অর্থ নিষ্কৃতি বা মুক্তি। সুতরাং শবেবরাত অর্থ হচ্ছে নিষ্কৃতি বা মুক্তির রাত। মহানবী সা: এ রাতটিকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ (শাবান মাসের মধ্যরজনী) হিসেবে অভিহিত করেছেন। বাংলাভাষী মুসলিমদের কাছে রাতটি ভাগ্যরজনী হিসেবে সুপরিচিত।
আল-কুরআনে শবেবরাত: ‘শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি তো এ কিতাব নাজিল করেছি এক মুবারক রজনীতে; আমি তো সতর্ককারী। এ রজনীতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। আমার আদেশক্রমে, আমি তো রাসূল প্রেরণকারী’ (সূরা দুখান, ৪৪ : ২-৫)।
শবেবরাতের পক্ষে যেসব মনীষী কুরআনের এ আয়াতগুলো দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন, তাদের দলিলটি যথাযথ বলে মনে হয় না। কারণ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা ‘লাইলাতুল কদর’ অর্থ নেয়াটাই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
কেননা কুরআন মাজিদের দুই জায়গায় স্পষ্ট ও পরিষ্কার ভাষায় মহান আল্লাহ বলেছেন : ‘রমজান মাস, এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে’ (সূরা বাকারা, ২:১৮৫)। ‘নিশ্চয় আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে’ (সূরা কদর, ৯৭:১)। তাই বলা যায়, আলোচ্য আয়াতে মুবারক রজনী বলতে ‘লাইলাতুল কদর’ বা কদরের রজনীই উদ্দেশ্য। শবেবরাত উদ্দেশ্য নয়।
হজরত আলী রা: বলেন রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন ১৫ শাবানের রাত আসে তখন তোমরা এ রাতে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর মহান আল্লাহ পৃথিবীর নিকটতম আকাশে আসেন।
তার পর তিনি বলেন, আমার কাছে কেউ ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। কেউ জীবিকার প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে জীবিকা দেবো। কোনো রোগাগ্রস্ত আছে কী? আমি তাকে আরোগ্য দান করব। ফজর হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে তিনি বলতে থাকেন’ (ইবনে মাজা)।
হজরত আবু মূসা আল আশআরী রা: থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ ১৫ শাবানের রাতে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ছাড়া অন্য সবাইকে ক্ষমা করে দেন’ (ইবনে মাজা)।
আলোচ্য হাদিসত্রয় পর্যালোচনা করে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মহান আল্লাহ এ রাতে প্রথম আকাশে আগমন করে ওই সব পাপীকে ক্ষমা করেন, যারা এ রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করেন। ক্ষমা প্রত্যাশীদের মধ্য থেকে মুশরিক এবং হিংসুকদের বাদ দেয়া হলেও মাজাহেরে হক কিতাবের ভাষ্য অনুযায়ী, আরো ১০ শ্রেণীর লোক আন্তরিকভাবে তওবা ছাড়া ক্ষমার আওতায় আসবে না। তারা হলো-
১. মা-বাবার অবাধ্যচারী
২. আত্মীয়তার সম্পর্ক কর্তনকারী
৩. মদপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি
৪. জেনাকারী
৫. জুলুম করে কর আদায়কারী
৬. জাদুকর
৭. গণক
৮. বাদ্যযন্ত্র বাদক
৯. ভবিষ্যৎ বক্তা
১০. পরিধেয় বস্ত্র টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরিধানকারী।
শবেবরাতে করণীয় কার্যাবলি:
১. সাধ্য অনুযায়ী ইবাদত বন্দেগি করা
২. দান খয়রাতের হাত প্রসারিত করা
৩. বেশি পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত করা
৪. নফল রোজা রাখা
৫. নিজের কৃত গুনাহ স্মরণ করে বেশি পরিমাণে তওবা করা
৬. মা-বাবার প্রতি সর্বদা দয়ার হাত প্রসারিত থাকবে এ প্রতিশ্রতি করে তাদের প্রতি যত্বাবন হওয়া
৬. আত্মীয়স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা
৮. মদ, সুদ, ঘুষ পরিহার করার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনে সচেষ্ট হওয়া
৯. জেনা-ব্যভিচার পরিহার করে এর সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কাজ পরিহার করা
১০. অন্যায়ভাবে অর্থ আদায় এবং আত্মসাৎ না করা
১১. গণকের কাছে ভাগ্যলিপি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য যাওয়াকে চিরতরে বন্ধ করা
১২. অশালীন গান, বাদ্যযন্ত্রসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান বর্জনের মানসিকতা তৈরি করা
১৩. ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করা বা তা বিশ্বাস করা পরিহার করা
১৪. পুরুষের টাখনুর নিচে পোশাক পরিধান বর্জন করা
১৫. গীবত, চোগলখুরি, পরনিন্দা ইত্যাদি পরিহার করা।
এক কথায়, একজন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার জন্য যা যা গুণ অর্জন প্রয়োজন শবেবরাতের ইবাদত বন্দেগি করার সাথে সাথে সে গুণগুলো অর্জনের দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করা।
শবেবরাতে বর্জনীয় কার্যাবলি:
শবেবরাত একটি ফজিলতপূর্ণ রাত। এ রাতে শরিয়তের নির্দেশ মোতাবেক ইবাদত করলে বিপুল নেকি অর্জন হয়। কিন্তু কিছু ভাগ্যহত মুসলিম এ রাতে এমন কতকগুলো শরিয়তবিরোধী কাজ করেন, যার ফলে গুনাহ মাফ হওয়ার পরিবর্তে আরো নতুন গুনাহ যোগ হয়। যেমন-
১. সারা রাত ইবাদত করে ফজর নামাজ না পড়ে ঘুমিয়ে পড়া
২. আতশবাজি ফুটানো
৩. হালুয়া-রুটি বিতরণ
৪. সরকারি-বেসরকারি ভবনে আলোকসজ্জা করা
৫. কবরস্থানগুলোতে আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো
৬. মৃত ব্যক্তিদের রূহ নিজেদের বাসস্থানে আসে এ ধারণা করা
৭. এ রাতে ঘুমানোকে অন্যায় মনে করা
৯. কমপক্ষে ১০০ রাকাত নামাজ পড়তেই হবে এ ধরনের ধারণা করা
১০. দলবেঁধে কবরস্থানে যাওয়াকে আবশ্যক মনে করা ইত্যাদি।
শেষ কথা: শবেবরাত আসে আবার চলে যায়। অনেক মুসলিম এ রাতটিকে নাজাত পাওয়ার উছিলা মনে করে সারা রাত ইবাদত করে থাকেন। তাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে; যাতে ফজরের নামাজ কাজা না হয় এবং ইসলামবিদ্বেষী কাজ করে ছাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ কামাই না হয়।
মনে রাখতে হবে, অনুষ্ঠানসর্বস্ব প্রাণহীন ইবাদতের কোনো মূল্য ইসলামে নেই। ইসলামের রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনকাঠামো।। তাই ভাগ্য উন্নয়ন এবং নাজাত লাভের জন্য দু-এক রাত জেগে ইবাদত করা বা তওবা ইস্তেগফার করাই যথেষ্ট নয়; বরং সামগ্রিক জীবনকেই কুরআন-সুন্নাহ মুতাবেক গঠিত ও পরিচালিত করতে হবে।