জি ইয়ুন, ৬ জুলাই ২০১৩:
দক্ষিন কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ২০,০০০ ইউএস ডলার অতিক্রম করেছে। অথচ কোরিয়ান চাকুরীজীবীরা নাকি সুখী নয়! ৩৬টি দেশের কর্মজীবীদের উপর চালানো এক জরিপে সুখী কর্মজীবী সূচকে দক্ষিন কোরিয়ার অবস্থান ২৭তম। তাছাড়া কোরিয়ার চাকুরেদের মানসিক স্বাস্থ্যও খুব একটা ভালো নয়। ২০১০ সালে দেশটিতে মানসিক চিকিৎসা নিয়েছেন ২৩ লাখের কিছু বেশী মানুষ যা কিনা ২০০৪ সালের তুলনায় ১৫০ শতাংশ বেশী।
সুখী কর্মজীবী সূচকে কোরিয়ার উপড়ে থাকা দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যায় কোরিয়ানরা অনেক বেশী সময় কর্মক্ষেত্রে কাটান। দীর্ঘ কর্মদিবস নিঃসন্দেহে মানসিক অবস্থার উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
যদি সুখী কর্মজীবীর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়, ‘যে কর্মজীবী নিজের কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট এবং কর্মজীবনের প্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে’ তাহলে আমরা আসলে কতজন সুখী কর্মজীবী পাবো? কোরিয়ার স্যামসাং ইকোনোমিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট (সেরি)-এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে আয়োজন করেছিল একটি জরিপের।
এতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা সুখী সূচকে পেয়েছেন ৫৫ পয়েন্ট। ৪৮ শতাংশ বলেছেন তাঁরা তাঁদের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সুখী নন। ৫৩ শতাংশ নিজের কাজের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কর্মজীবনের প্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন ৬৫ শতাংশ। আবার বয়সের সাথেও সুখী কর্মজীবীর সংখ্যা বাড়ে। সেরি’র ২০ বছর বয়সী কর্মীদের ৪৮ শতাংশ যেখানে নিজেদের সুখী দাবী করেছেন, সেখানে ৫০-৫৫ বছর বয়সীদের মাঝে এমন দাবীদার ৬১ শতাংশ।
এ জরিপে করা বিভিন্ন প্রশ্নের উপর ভিত্তি করে সেরি কর্তৃপক্ষ কর্মক্ষেত্রে সুখী হওয়ার ছয়টি পরামর্শ সম্বলিত একটি ‘সুখী কর্মজীবী মডেল’ প্রস্তাব করেছে। তাঁরা বলছে, এর মাধ্যমে কর্মীদের মাঝে মানসিক দৃঢ়তা, কর্মোদ্যম ও পারস্পরিক সহযোগিতার অভ্যাস গড়ে উঠবে। আর সেজন্য কর্মীদের নিজস্ব প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা।
প্রথমত, প্রত্যেককে তাঁর কথায় ও কাজে ইতিবাচক হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আচার-ব্যবহারে নেতিবাচক কথাবার্তা পরিহার করতে হবে। সর্বোপরি, এমন একটা কর্মপরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে কর্মীরা একে অপরের জন্য সহায়ক হবে এবং পেশাদারি সৌজন্যবোধ মেনে চলবে।
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ সময় এক জায়গায় বসে না থেকে শরীরটাকে একটু নাড়াচাড়া করান। এজন্য লিফট যথাসম্ভব এড়িয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করা যেতে পারে। মধ্যাহ্নভোজনের পর একটু পায়চারী করে নিতে পারেন, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব ছোটখাটো অভ্যাস একটানা কাজ করার একঘেয়েমি থেকে মুক্ত রাখবে।
তৃতীয়ত, কর্মক্ষেত্রে কাজের মূল্যায়ন থাকাটা জরুরী। হাসপাতালের যে কর্মকর্তারা রোগীদের সাথে কথাবার্তা বলেন এবং নার্সদের সহযোগিতা করেন তাদের কর্মতুষ্টির মাত্রাটা অনেক বেশী থাকে। অন্যান্য বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও চাইলে তাদের কর্মীদেরকে সরাসরি দেখাতে পারে যে ভোক্তাদের উপর তাঁরা কেমন প্রভাব রাখতে সক্ষম হচ্ছে। মার্কিন চিকিৎসা যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মেডট্রোনিক এর যেসব পন্য বাজারে খুব জনপ্রিয়তা পায় সেসবের ব্যবহারকারীদের সাথে ওইসব পন্য প্রস্তুতকারীর কথোপকথনের সুযোগ করে দেয়। এভাবে ব্যবহারকারীরা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ পান। এটা নিঃসন্দেহে ওই কর্মীদেরকে বাড়তি অনুপ্রেরণা যোগায়।
চতুর্থত,একজন কর্মীকে তার সেরা দক্ষতার ক্ষেত্রটি খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটার উন্নয়নে লেগে থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেরও উচিৎ প্রশিক্ষণের সময়ই কে কোন কাজে বেশী দক্ষ তা সনাক্ত করে তাঁকে সে কাজেই নিয়োগ দেয়া।
পঞ্চমত, সহকর্মীদেরকে সবসময় আনন্দ ও উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করুন। কাজের উপযুক্ত স্বীকৃতি এবং আনন্দের মুহূর্তগুলো ভাগ করে নেয়াটাও কর্মীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। অধস্তনদের প্রতিটা কাজের গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে তাঁদেরকে সতেজ থাকতে সহযোগিতা করুন।
ষষ্ঠত,একে অন্যের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশটা বন্ধুত্বপূর্ণ হলে সেখানে সুখে থাকাটা অনেক বেশী সহজ হয়।
কাজের যথাযথ স্বীকৃতি এবং মানবিক আচার-ব্যবহার কেবল একজন কর্মীকেই ভালো থাকতে সাহায্য করে না, কাজের পরিবেশটাও অনেক বেশী আরামদায়ক করে তোলে। এজন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষও কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধুত্ব স্থাপনে উদ্যোগী হতে পারে।
সর্বোপরি, ‘আমাকে সুখী হতে হবে’ এমন মানসিকতা নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে এবং কখনই তা থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। ইতিবাচক আশাবাদের সার্বক্ষণিক চর্চাই পারে একজন কর্মজীবীকে সুখী রাখতে।
লেখকঃ গবেষক, স্যামসাং ইকোনোমিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট
অনুবাদঃ মোঃ মহিবুল্লাহ