
বাংলাদেশের রাজনীতি অনেক দিক থেকে বদলেছে, কিন্তু রাজনৈতিক যোগাযোগের ধরণ সেই পুরোনো পথেই আটকে আছে। সমাজ বদলেছে, মানুষের জীবন বদলেছে, যোগাযোগের মাধ্যম বদলেছে—কিন্তু রাজনৈতিক বার্তা এখনো আগের মতোই স্লোগান, লম্বা বক্তৃতা আর চিরচেনা প্রতিশ্রুতিতে ভর করে। সমস্যাটা এখানেই। মানুষ এগিয়ে গেছে, রাজনীতির বার্তা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।
আজ যেটা সবচেয়ে জরুরি, তা হচ্ছে—বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে ভাবতে হবে। আর সেই ভাবনার কেন্দ্রে থাকবে মার্কেটিং কৌশল। কারণ, বাস্তবতা হলো: রাজনীতি মূলত মানুষের মনোভাব, আশা-আকাঙ্ক্ষা, মূল্যবোধ আর আস্থার সঙ্গে কাজ করে। আর এগুলো বোঝার সবচেয়ে শক্তিশালী পদ্ধতি হলো আধুনিক মার্কেটিং।
কেন রাজনীতিতে মার্কেটিং জরুরি
মার্কেটিং মানে মানুষের চাহিদা বোঝা, তাদের বাস্তবতা অনুধাবন করা, এবং সেই অনুযায়ী মূল্য তৈরি করা। রাজনীতিও তাই। কিন্তু যখন রাজনৈতিক বার্তা মানুষের আচরণ, অনুভূতি কিংবা প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না—তখন আস্থার সংকট তৈরি হয়।
একটা শক্তিশালী ব্র্যান্ড যেভাবে গ্রাহকের কথা শোনে, বিশ্লেষণ করে, তারপর বার্তা তৈরি করে; রাজনীতিকেও ঠিক সেই পথেই হাঁটতে হবে। শুধুই জোরে বলা বা বেশি বলা আর কাজ করছে না। মানুষ এখন জানতে চায়—এর ভেতরের বার্তা কী? কেন এটি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
যে জনগোষ্ঠীর জন্য রাজনীতি চলছে, তারা বদলে গেছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিশাল অংশ এখন তরুণ। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউব, আন্তর্জাতিক কনটেন্ট—সবকিছুর সঙ্গে তারা বড় হয়েছে। এই প্রজন্ম মনোযোগ দেয় তথ্যভিত্তিক কথায়, যুক্তির ভাষায়, দৃশ্যমান উদাহরণে। তারা স্লোগানে উজ্জীবিত হয় না; তারা প্রশ্ন করে:
পরিকল্পনা কী?, বাস্তবায়ন কিভাবে হবে?, আমার জীবনে কী পরিবর্তন আসবে? কিংবা আপনার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করব কেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আপনাকে গবেষণা, ডেটা, আধুনিক বিশ্লেষণ—সবকিছু ব্যবহার করতে হবে। এটিই রাজনৈতিক মার্কেটিং।
রাজনীতিতেও ব্র্যান্ড পজিশনিং লাগে
রাজনৈতিক দল শুধু সংগঠন নয়; এটি একটি ব্র্যান্ডও। জনগণ দলের সম্পর্কে কী ভাবছে, কোন বিষয়কে তার পরিচয় হিসেবে দেখে, কোথায় আস্থা হারিয়েছে—এসবই ব্র্যান্ড ধারণার অংশ।
এখন প্রশ্ন হলো-
* দল আজকে কী দাঁড়ায়?
* কোন সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে শক্তিশালী?
* মানুষের চোখে এটিকে বিশেষ করে কী?
* অতীতের গল্প ছাড়াও বর্তমানের অবস্থান কী?
যখন একটি দল তার ব্র্যান্ড পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না, তখন বার্তা এলোমেলো হয়, নেতারা আলাদা ভাষায় কথা বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া দলকে একরকম দেখায় না—এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে দূরে সরে যায়।
একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্র্যান্ড জনগণকে স্পষ্ট সংকেত দেয়—এটাই আমাদের অবস্থান, এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি, আর এটাই আমাদের পথ।
ডেটা ছাড়া রাজনৈতিক কৌশল এখন আর চলে না
বিশ্বের রাজনীতিতে এখন ডেটাই শক্তি। উন্নত দেশ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশগুলো—সবখানেই ভোটার গবেষণা, সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস, জিও-টার্গেটেড বার্তা, ডিজিটাল আচরণ বিশ্লেষণ—এসবই রাজনৈতিক কৌশলের কেন্দ্র।
বাংলাদেশ যদি এখনো চিরাচরিত ধারণার ওপর ভর করে রাজনৈতিক বার্তা তৈরি করে, তাহলে জনগণের মনোভাব ভুল পড়ার ঝুঁকি বাড়বে।
ডেটা বলে দেয়- কোন বয়সী জনগোষ্ঠী কোন সমস্যা নিয়ে বেশি চিন্তিত, শহর আর গ্রামের মানুষের চাহিদা কোথায় আলাদা, কোন শব্দ নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি করে, কোন বার্তা আশা জাগায়, কোন নীতি জনগণের চোখে বিশ্বাসযোগ্য। ডেটা মূলত রাজনীতিকে বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত রাখে।
রাজনৈতিক যোগাযোগের ধরন নতুনভাবে সাজাতে হবে
এখন মানুষ আর লম্বা বক্তৃতা শোনার সময় পায় না। তারা স্টোরি দেখে, গ্রাফিক্স দেখে, ছোট ভিডিও দেখে। রাজনৈতিক বার্তা তাই হওয়া উচিত সংক্ষিপ্ত, অথচ অর্থবহ।
আজকের কার্যকর রাজনৈতিক যোগাযোগ মানে- ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং, দ্রুত বার্তা পৌঁছে দেওয়া, ফ্যাক্ট চেকিং, সংকটের সময়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া, ঘন ঘন আপডেট, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধারাবাহিক উপস্থিতি, এসব।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—সংলাপ। শুধু বলা নয়, শুনতে শেখাও। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বার্তা অনেক সময় একমুখী থাকে। আর একমুখী যোগাযোগ আজকের প্রজন্ম গ্রহণ করে না।
নীতি ও প্রতিশ্রুতিকে গল্পের ভাষায় বলতে হয়
নীতিমালা যতই ভালো হোক, যদি মানুষ বুঝতে না পারে—তাহলে কোনো লাভ নেই। উন্নয়ন, সংস্কার, কর্মসংস্থান, শিক্ষা—এসবই মানুষের জীবনের সঙ্গে গল্প হিসেবে বাঁধা থাকতে হয়। একটি নীতি মানুষের জীবনে কিভাবে পরিবর্তন আনবে—এই গল্পটাই জনগণ মনে রাখে।
রাজনৈতিক মার্কেটিং এই গল্প তৈরির পথ দেখায়।
সবচেয়ে বড় সংকট—আস্থা, আর সেটি ফিরিয়ে আনার পথও মার্কেটিং
বাংলাদেশে এখন আস্থার সংকট সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষ নেতা, দল, প্রতিষ্ঠান—সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে। আস্থা ফিরে আসে ধীরে ধীরে—স্বচ্ছতা, নিয়মিত যোগাযোগ, এবং সৎ ব্যাখ্যার মাধ্যমে।
একটি আধুনিক রাজনৈতিক মার্কেটিং কৌশল আস্থা পুনর্গঠনে সাহায্য করে এজন্য দরকার মানুষের মতামত নিয়মিত শোনা। ভুল হলে স্বীকার করে সংশোধনের ব্যাখ্যা দেওয়া। নীতিকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা। জনগণের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নকে চোখে দেখানোর মতো বিষয়গুলো।
যখন মানুষ অনুভব করে যে তাদের কথা শোনা হচ্ছে—আস্থা আবার জাগে।
বাংলাদেশের সামনে এখন যে পথ
বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যার দিক থেকে তার সবচেয়ে গতিশীল সময়ে। তরুণেরা স্বপ্ন দেখে, তুলনা করে, প্রশ্ন করে, বিকল্প খোঁজে। তারা রাজনীতিতে নতুন ধরনের ভাষা খুঁজছে—সৎ ভাষা, যুক্তির ভাষা, বাস্তবতার ভাষা।
স্লোগান দিয়ে আর কাজ হবে না। এখন দরকার কৌশল। এমন কৌশল যেটা মানুষের কথা শোনে, বোঝে, ব্যাখ্যা করে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারে, তাহলে তিনটি বড় লাভ হবে- জনগণ রাজনীতিতে আরও সম্পৃক্ত হবে। নীতির বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছাবে এবং আস্থার সংকট কমে আসবে।
স্লোগান থেকে কৌশলে—এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন যাত্রা। যে দল জনগণকে বুঝতে পারবে, শুনতে পারবে, গল্পের ভাষায় কথা বলতে পারবে—রাজনীতির ভবিষ্যৎ সেই দলের পক্ষেই যাবে।
এটাই নতুন রাজনৈতিক মার্কেটিংয়ের প্লেবুক। এখন সময় সেটা কাজে লাগানোর।
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা







































