শুক্রবার । ডিসেম্বর ১২, ২০২৫
ড. শরিফুল ইসলাম দুলু মতামত ৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৫ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

বেগম খালেদা জিয়া: মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার আলোকবর্তিকা


Begum Khaleda Zia

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুটি কয়েক ব্যক্তি গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে বারবার উঠে এসেছেন— তাঁদের উত্তরসূরী বেগম খালেদা জিয়া

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে, যেখানে বিভাজন, অবিশ্বাস এবং অপমাননির্ভর বাক্যযুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে যে মূল্যবোধ—তা হলো মর্যাদা। সাম্য, সৌজন্য, রাজনৈতিক সম্পর্কের সম্মান—এই তিনটি স্তম্ভ যেদিন রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরে গেল, সেদিন থেকেই দেশ ধীরে ধীরে কঠোরতা, ভীতি আর অস্থিরতার দিকে এগোতে শুরু করল। এই ভাঙন শুধু দলগুলোর মধ্যেই নয়; সমাজের মনের ভেতরেও তৈরি করেছে গভীর ক্ষত।

ঠিক এমন সময়ে বেগম খালেদা জিয়ার নাম আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। এটি শুধুই একটি দলের রাজনৈতিক প্রত্যাশা নয়—এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুন করে ভাবার আহ্বানও বটে। তাঁর দীর্ঘ সংগ্রাম, অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় উপস্থিতি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়—রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতার প্রতিযোগিতা নয়; এটি মানুষের প্রতি সম্মান, প্রতিপক্ষের প্রতি সহনশীলতা এবং জাতির প্রতি নৈতিক দায়বদ্ধতার বিষয়।

বিষয়টি একটু গভীরে গিয়ে দেখা যাক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুটি কয়েক ব্যক্তি গণতান্ত্রিক ভারসাম্যের প্রতীক হিসেবে বারবার উঠে এসেছেন— তাঁদের উত্তরসূরী বেগম খালেদা জিয়া। তাঁরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে রাজনীতিকে মানবিকতা দিয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক আচরণে যে কঠিনতা, অশ্রদ্ধা ও প্রতিহিংসা দেখা যাচ্ছে—তা আমাদের সেই ঐতিহ্য থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

রাজনীতি আর মানুষের সম্পর্ক নয়—এখন হয়ে উঠেছে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। ভিন্নমতকে সম্মান করার সংস্কৃতি যেন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। আজকের বাস্তবতায় কেউ যদি প্রশ্ন তোলে, তাঁকে প্রতিপক্ষ নয়, শত্রু মনে করা হয়।

বিরোধীতাকে গণতন্ত্রের অংশ না দেখে, তা দমন করার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে করে রাজনৈতিক ভাষা কঠিন হয়েছে, মনোভাব আরও কঠিন হয়েছে, এবং মূল্যবোধ প্রায় লুপ্ত।

এই ভাঙা জমিনে বেগম খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য ফিরে আসা যেন এক আলোর রেখা।

কারণ তিনি সেই নেত্রী, যিনি রাজনীতিকে সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখতেন। বিরোধী দলের নেত্রী হয়েও প্রতিবাদের ভাষা কখনো মর্যাদা হারায়নি। সরকারে থাকলেও প্রতিপক্ষের জন্য রাজনৈতিক জায়গা রাখার বিষয়টি তাঁর কাছে ছিল গণতন্ত্রের শিষ্টাচার। এটাই তাঁকে আলাদা করে তুলে।

অনেকেই বলেন—রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা মানে শুধু সময় নয়; অভিজ্ঞতা মানে ধৈর্য, আত্মসংযম, এবং প্রতিপক্ষের অবস্থান বোঝার ক্ষমতা। এই তিনটি গুণই তাঁর মধ্যে ছিল প্রবলভাবে। তিনি জানতেন—ক্ষমতা আসে যায়, সরকার বদলায়, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য থাকবে শুধু কঠোরতা আর বঞ্চনা।

আজকের বাংলাদেশ সেই কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। বিভাজন এত গভীর যে এক টেবিলে দুই পক্ষ বসতেই ভয় পায়। শ্রদ্ধাহীনতার পরিবেশ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে সমালোচনা করলে সন্দেহ, প্রতিবাদ করলে শাস্তি, আর ভিন্ন কণ্ঠ তুললেই হয়রানির ভয়।

একটা দেশ যতই উন্নয়ন করুক, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস হলে সমাজের মনন, মূল্যবোধ এবং মানুষের দুর্বার চেতনা—সবই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে। ইতিহাস এভাবে কখনোই কোনো জাতিকে ক্ষমা করেনি।

এখন প্রশ্ন হলো—এই ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা কি আবার মর্যাদাপূর্ণ রাজনীতিতে ফিরতে চাচ্ছি?

যদি চাই, তাহলে একজন অভিজ্ঞ, সম্পর্ক-সংরক্ষণকারী নেত্রীর প্রয়োজন আছে। তাঁর উপস্থিতি শুধু প্রতীক নয়—এটি একটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে সম্মান-নির্ভর রাজনীতি একসময় ছিল, এবং চাইলে আবারও গড়া সম্ভব।

বেগম খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য সংকট পেরিয়েছেন—কখনো রাষ্ট্রক্ষমতার চাপে, কখনো ব্যক্তিগত আঘাতে, কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঝড়ে। তবুও তাঁর আচরণে অহংকারের কড়া ভাষা দেখা যায়নি। তিনি শিখিয়েছেন—দৃঢ়তা মানে উচ্চ স্বর নয়; দৃঢ়তা মানে নিজের অবস্থানকে মর্যাদার সঙ্গে ধরে রাখা। তাঁর বিশাল রাজনৈতিক যাত্রা একজন জননেত্রীর মানসিক শক্তিকে নতুনভাবে চিহ্নিত করেছে।

আজ যখন দেশ রাজনৈতিকভাবে ক্লান্ত, তখন তাঁর ফিরে আসা অনেককে মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতিতে মানবিকতা, সম্মান এবং ভারসাম্যই আসল শক্তি। প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়, প্রতিযোগী হিসেবে দেখার যে প্রথা—তা তাঁর সময়েই দৃশ্যমান ছিল।

সংলাপহীন রাজনীতি কোনো দিনই স্থায়ী হতে পারে না। যে রাজনীতি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাহীন হয়, সেখানে উত্তাপ বাড়ে, আস্থা কমে, আর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। তাই আজ প্রয়োজন নরম ভাষা, সংলাপের দরজা খোলা রাখা, এবং সম্পর্কের সেতু পুনঃর্নির্মাণ করা। বেগম খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন সেই আলোচনাকে সামনে আনার সম্ভাবনা রাখে।

মর্যাদাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি মানে শুধুই সৌজন্য নয়। এটি ন্যায়বোধ, ক্ষমতার দায়িত্ববোধ, নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার পরিপক্বতা, এবং জাতির স্বার্থকে ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থের উপরে স্থান দিতে পারার মানসিকতা।

ঠিক এই জায়গায় এসে তাঁর নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি জানেন রাজনীতিকে মানবিক করতে কী প্রয়োজন। জানেন, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা কীভাবে আসে। জানেন, সম্পর্ক ভাঙা নয়—সম্পর্ক তৈরি করাই বড় কাজ।

এই সংকটময় মুহূর্তে দেশ নতুন দিক খুঁজছে। সামনে এগোতে হলে আমাদের এমন এক নেতৃত্ব প্রয়োজন, যে নেতৃত্ব আবারও মনে করিয়ে দিতে পারে—রাজনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সম্মান। প্রতিপক্ষকে সম্মান দিলে রাজনীতি টিকে থাকে, রাষ্ট্র বাঁচে, সমাজ এগোয়।

বেগম খালেদা জিয়া সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনার আলোকবর্তিকার মতো। তাঁর সম্ভাব্য ফিরে আসা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা নয়; এটি আমাদের হারিয়ে যাওয়া মর্যাদার রাজনীতি ফিরিয়ে আনার আশা।

এখন প্রশ্ন—আমরা কি সেই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত?

ড. শরিফুল ইসলাম দুলু: বিপণন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, নীতি পরামর্শক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। মার্কেটার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সেক্রেটারি জেনারেল এবং মার্কটেল কনসাল্টিং গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

[এই বিভাগের মতামত লেখকের নিজস্ব]