
নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
শ্বেত পাথরে বাঁধানো এক সমাধি। অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণার পানিহাটি পৌরসভার অন্তর্গত সোদপুরে। কবরটি পানিহাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত।
প্রশ্ন হলো, কবরটিতে শুয়ে আছেন কে? উত্তরটি জানলে চমকে যাবেন অনেকেই। এখানেই শায়িত আছেন নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন!
অনেকেই হয়ত এই তথ্য জানার পর বিশ্বাস করতে পারবেন না। বেগম রোকেয়া যে রংপুরের পায়রাবন্দের মানুষ, তা তো অনেকেই জানেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনকে বিয়ে করে তিনি বিহারের ভাগলপুরের অধিবাসী হন৷ সেখানে স্বামীর উৎসাহেই প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
তবে তার স্বামীর প্রয়াণ ঘটলে তিনি শ্বশুরবাড়ির প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে সেই স্কুল বন্ধ করে কোলকাতায় চলে আসেন৷ সালটা ১৯০৭।

স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বেগম রোকেয়া
এরপর কোলকাতাতেই সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে নারীশিক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তবে এজন্য তাকে কম প্রতিকূলতা সহ্য করতে হয়নি। সে সময় ব্রাহ্ম সমাজের নারীরা তার সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন।
সে সময় তাদের অনুরোধে ও রোকেয়ার পরিকল্পনায় শেরপুরের জমিদার কোলকাতায় ‘গোবিন্দকুমার হোম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে অনাথ মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, সাংসারিক কাজে দক্ষতা অর্জন ও বিয়ের ব্যবস্থা করা হতো। ১৯২৮ সালে এমন এক অনাথ মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথও এসেছিলেন।
কোলকাতায় রোকেয়া চলে আসার পর তার ছোট বোন হোমায়রাও তার কাছে চলে আসেন। হোমায়রার স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী অল্পবয়সেই মারা যান। শিশু সন্তান আমীর হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে হোমায়রা রোকেয়ার কাছে এসে ওঠেন৷ তারা বেশ কিছুকাল একসঙ্গেই ছিলেন। পরে হোমায়রার মৃত্যু ঘটে। আমীর হোসেন চৌধুরীকে নিঃসন্তান রোকেয়া পুত্রসম স্নেহ করতেন। আমীর হোসেন চৌধুরী পরবর্তীতে ঢাকা চলে আসেন। নজরুল গবেষক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা ঠেকাতে গিয়ে তিনি নিহত হন।
রোকেয়ার অমানুষিক পরিশ্রম ও মানসিক উদ্বেগ তার স্বাস্থ্যকে ভেঙে দিচ্ছিল। মাত্র ৫২ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কোলকাতার ১৬২ লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে (বর্তমানে সেখানে ভুপেশ ভবন অবস্থিত) মৃত্যুবরণ করেন রোকেয়া। কিন্তু কবর দেয়ার জন্য মিলছিল না জায়গা। রোকেয়া অতটা সামর্থ্যবান ছিলেন না যে, তিনি কবরের জায়গা কিনে রাখবেন। তার ওপর নারীশিক্ষা নিয়ে কাজ করা, পর্দাপ্রথার সমালোচনার ফলে কোলকাতার তৎকালীন মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই তার ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। তাই তাকে কোলকাতায় কবর দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা আসে।

এরপর জনৈক আবদুর রহমানের জমিতে ৯ ডিসেম্বর বিকেলে বেগম রোকেয়াকে কবরস্থ করা হয় । এই জমিটি ছিলো পানিহাটির সোদপুরে, গঙ্গার তীরে।
তবে কে এই আবদুর রহমান- এটিই এখন পর্যন্ত বড় এক রহস্য। এমন কথা কেউ কেউ বলেছেন যে, আবদুর রহমান রোকেয়ার ছোট বোনের স্বামী। কিন্তু তার ছোট বোন হোমায়রা স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করেছিলেন, এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।
আবার কেউ কেউ বলেছেন, এই আবদুর রহমান রোকেয়ার কোনো কাজিনের স্বামী। তবে সেটিও নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নয়। তিনি পরবর্তীতে ‘জ্যোতির্ময়ী রোকেয়া’ নামে বইও লেখেন।
এক্ষেত্রে আবার পাওয়া যায় আরেকটি মত। রোকেয়ার ভাইয়ের পৌত্রী মাজেদা সাবের বলেছিলেন যে, রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা খানম চৌধুরানীর ছেলে স্যার আবদুল করিম গজনবীর উদ্যোগে রোকেয়াকে পানিহাটিতে সোদপুরের সুখচরে এই পারিবারিক কবরস্থানে কবর দেয়া হয়। রোকেয়ার বড় বোনের কবরও এখানেই।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, আবদুর রহমান নামে যার কথা বলা হয়, বলা হয় যে, সোদপুরের এই গোরস্থান তার পারিবারিক গোরস্থান। কিন্তু তার পরিবারের আর কার কার কবর এখানে আছে, সেরকম কারো পরিচয়ও শনাক্ত করা যায়নি।
১৯৯৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমলেন্দু দে দীর্ঘ গবেষণার পর এই কবর চিহ্নিত করেন। ১৯৯৭ সালের ৯ ডিসেম্বর বদরুদ্দীন উমর রোকেয়ার কবরে স্মৃতিফলক উন্মোচন করেন।

পানিহাটিতে বেগম রোকেয়ার সমাধি ফলক
পানিহাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি আগে থেকেই আবদুর রহমানের জমিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ছিল৷ ১৯৪৬ সালে এটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় এমন পাওয়া যায়, রোকেয়া চাইতেন তার কবর কোনো নারী শিক্ষাঙ্গনের পাশে হোক। সেই আকাঙ্খা শেষপর্যন্ত পূরণ হয়েছে।
তবে কথা হলো, স্যার আবদুল করিম গজনবী তো বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। যদি এটি তাদের পারিবারিক গোরস্থানই হবে, তাহলে তো আর এ নিয়ে কোনো রহস্যই থাকে না। কিন্তু সেক্ষেত্রে, আবদুর রহমানের প্রসঙ্গটা আসে কোথা থেকে? তিনি কি তাহলে গজনবী সাহেবদের সম্পত্তির দেখভাল করতেন বা এমন কিছু? কিন্তু এরও কোনো স্পষ্ট উত্তর মেলে নি।
তাই শেষপর্যন্ত রোকেয়ার কবর পানিহাটির সোদপুরে গঙ্গার ধারে হবার ব্যাপারটি নিশ্চিত হলেও জমিদাতা হিসেবে নাম আসা আবদুর রহমান আসলে কে ছিলেন- তা আজ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি।










































