
তাঁর জনপ্রিয়তা এমন ছিল যে শহরের অনেক প্রথিতযশা শিল্পীও তাঁর পরিবেশনার পর মঞ্চে গান গাইতে সাহস পেতেন না
‘তুমি আর এক বার আসিয়া/যাও মোরে দেখিয়া/আমি নয়ন ভরে একবার দেখতে চাই’
কিংবা ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী’র মতো অসংখ্য
তুমুল জনপ্রিয় গানের শিল্পী গোষ্ঠ গোপাল দাসের মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
রাত যখন নেমে আসে, গ্রামবাংলার হাট, ঘাট, স্টেশন আর খেয়াঘাটগুলো নিস্তব্ধ হয়ে থাকে। তখনই কোথাও কোথাও ভেসে আসে এক অদ্ভুত কণ্ঠের সুর। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কী’, ‘ঘুমায়ো না আর বেহুলা, জাইগা থাকো রে’, ‘ও নাগর কইয়া যাও, কোন বা দেশে যাও, আমার পরান কান্দে’, কিংবা ‘তুমি আর এক বার আসিয়া/যাও মোরে দেখিয়া/আমি নয়ন ভরে একবার দেখতে চাই’—কোনও দোকানদার বা রাতজাগা মানুষ হঠাৎ এই গান গাইতে শুরু করে, আর মুহূর্তের মধ্যে পুরো স্থানটাই যেন গানের সঙ্গে মিলেমিশে যায়।
এই কণ্ঠের মালিক হলেন গোষ্ঠ গোপাল দাস, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলার মানুষদের হৃদয় দখল করেছেন। তাঁর গানগুলো কেবল সুর নয়; তা জীবনের যন্ত্রণা, প্রেমের ব্যথা, ভাঙা আশা আর মানুষের অনুভূতির নীরব প্রতিবিম্ব। বাউল সঙ্গীতের আকাশে তিনি ছিলেন এক অদ্বিতীয় নক্ষত্র, যার ছায়া আজও গ্রামের প্রতিটি বাঁধ, পথ ও মাঠে বিরামহীনভাবে ভেসে বেড়ায়।
অবিভক্ত দিনাজপুরের এক অখ্যাত গ্রামে, ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি, জন্মগ্রহণ করেন গোষ্ঠ গোপাল। বাবা দীনবন্ধু দাস ও মা হরিদাসীও ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের। শৈশব কেটেছিল হুগলির লক্ষ্মণপুর গ্রামে। ছোটবেলায় বাবা তাঁকে শেখান বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, জারি ও মারফতি গান। কিশোর বয়সে মেঠো পথে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর সময় গান গাইতেন, আর তাঁর সুর মাঠের পর মাঠে পৌঁছে যেত। কৃষকরা ধান বোনা থামিয়ে, তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তাঁকে শোনার জন্য।

যুবক বয়সে গোষ্ঠগোপাল নিজের জীবনকে পুরোপুরি বাউল সঙ্গীতে উৎসর্গ করেন। সংসারের দারিদ্র্য তাঁকে বাধ্য করেছিল পথঘাট, ট্রেন-স্টেশন ও হাটে গান গাইতে। কখনও একা, কখনও মাজন বা জড়িবুটি বিক্রেতাদের সঙ্গে। সামান্য টাকা হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকারে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতেন, সেই অল্প অর্থ দিয়েই সংসার চালাতেন স্ত্রী গীতা দেবীর সঙ্গে।
তাঁর কণ্ঠে এমন এক শক্তি ছিল, যা মানুষকে নিজে টেনে আনে। গ্রামের মানুষ হঠাৎ থেমে যেত, গান শুনতো, মোহিত হত। তাঁর নাম ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল হাট, মাঠ ও বাজারে। জড়তাহীন উচ্চারণ, সহজাত সুরের খেলা—সবই মানুষকে বুঁদ করে রাখত। ‘বাউল গুরু’ সুবল দাস তাঁকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। নদীয়ার আড়ংঘাটার মঞ্চে প্রথমবারের মতো তাঁকে গান গাইবার সুযোগ করে দেন সুবল দাস। প্রথম মুহূর্তেই শ্রোতাদের মন জয় করলেন গোষ্ঠ গোপাল। বাংলা চিনল বাউল সঙ্গীতের আকাশে এক নতুন তারাকে।
ধানহাটায় স্থায়ীভাবে ঘর বাঁধলেন বোহেমিয়ান গোষ্ঠ গোপাল।তাঁর কুটির হয়ে উঠল ক্ষ্যাপা বাউলদের আখড়া। হাতে খমক, কপালে রসকলি, খোঁপা বাঁধা চুল—সুন্দর, সুঠাম, শ্যামবর্ণের এই মানুষটি নিজের সুরের মাধ্যমে গ্রামবাংলার হৃদয় দখল করলেন। সেই সময় এমন কোনও গ্রাম ছিল না, যেখানে পা পড়েনি তাঁর।

ক্যাসেটের যুগে তাঁর গান ঝড় তুলল। ময়ূর, করণ-কিরণ ও গাথানি কোম্পানি থেকে প্রকাশিত প্রতিটি ক্যাসেটই বাজারে আসতেই হিট। শহরের দোকানে বিক্রি কম, কিন্তু গ্রাম-গঞ্জ ও শহরতলির দোকানগুলোতে তা উল্কাগতিতেই বিক্রি হত। মানুষের অন্তরে পৌঁছাল গোষ্ঠ গোপালের সুর। ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’, ‘ট্যাংরা তবু কাটন যায়’, ‘ঘুমায়ো না আর বেহুলা’, ‘হায় রে এমন জ্বালা’, ‘ইঁদুর মারার কল রয়েছে’, ‘পাখি যখন দেবে উড়াল’, ‘দম ফুরালে যাবো মিশে’, ‘ওরে হাড় মোর জ্বলিয়া গেল’, ‘আর যাব না রথের মেলাতে’, ‘আমার বউ আমার কথা শোনে না’, ‘জয় শিব শঙ্কর পরম ঈশ্বর’, ‘কেহ আমায় দিল ব্যাথা’, ‘আমার বন্ধু রইল কোনবা দেশে’, ‘পরাণ বন্ধু রে’, ‘পিরীত হল ভাঙ ধুতুরার ফুল’, ‘আমার বাউল ঘরে জনম যেন হয় গো বারে বার’, ‘গুরু না ভজি মুই’—এই গানগুলো মানুষের হৃদয় চিরকাল দোলা দিয়ে যাবার মতো।
তাঁর জনপ্রিয়তা এমন ছিল যে শহরের অনেক প্রথিতযশা শিল্পীও তাঁর পরিবেশনার পর মঞ্চে গান গাইতে সাহস পেতেন না। তাঁর নাইটের ভিড় সামলাতে পুলিশ নামাতে হতো। গোষ্ঠ গোপাল গান গেয়েছিলেন আকাশবাণী ও কলকাতা দূরদর্শনে। লন্ডনের মঞ্চেও মাতোয়ারা করেছিলেন শ্রোতাদের। শহরের আলো, বর্ণময় পরিবেশ, হট্টগোল—কোনওটিই তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি। শহর তাঁকে দিতে পারেনি আসল স্বীকৃতি; গ্রামবাংলা ছিল তাঁর প্রকৃত মঞ্চ।

সরল ও সংবেদনশীল গোষ্ঠ গোপাল বুঝতে পারেননি সঙ্গীত জগতেও কী জঘন্য হিংসা থাকতে পারে! নিজের প্রতিভার কদর করা নিয়ে তিনি বিশেষ সচেতন ছিলেন না। এর ভেতর তাঁর তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা অনেকের মাথাব্যথার কারণ হলো। সেসব লোক একজোট হলেন। উদ্দেশ্য একটাই- গোষ্ঠ গোপালকে ঠেকাও। তাঁর জীবনে নেমে এলো গ্রহণকাল। তুমুল জনপ্রিয়তা, কিন্তু কেউ গাইতে ডাকে না। তিনি গাইলে অন্য কোনো কোনো গায়ক সেসব অনুষ্ঠান বর্জন করতে চান।
একসময় প্রচুর রোজগার করলেও গোষ্ঠ গোপাল কিছু ধরে রাখতে পারেননি। জীবনের শেষ প্রান্তে অর্থকষ্ট তাঁকে গ্রাস করেছিল। দুঃখ ভুলতে আশ্রয় নিয়েছিলেন নেশার কাছে, সার্বক্ষণিক সঙ্গী তখন মদ। মৃত্যুর বহু আগে তিনি গেয়ে রেখেছিলেন শ্রী শ্রী প্রণবানন্দ মহারাজের লেখা ও সুর করা গান, “খেলা শেষ তোর করে নে মন, যাওয়ার দিনের দেরি নাই।”
১৯৮৬ সালের ৪ ডিসেম্বর, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, দুই স্ত্রী, এক পুত্র, তিন কন্যা ও কোটি কোটি শ্রোতাকে কাঁদিয়ে তিনি চলে যান। তাঁর লিভার পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আজ প্রায় চার দশক হতে চলল গোষ্ঠ গোপাল দাস নেই। তবে আজও গ্রামবাংলার কোনও রেলস্টেশনে বা খেয়াঘাটে রাতজাগা প্রৌঢ় চা দোকানি হাতে তুলে নেন অনেক কষ্টে বাঁচিয়ে রাখা বিবর্ণ ক্যাসেট। নিশাচর পাখিদের সঙ্গী হয়ে ভেসে আসে গোষ্ঠ গোপালের ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠ — ‘আমি এমন মানুষ পেলাম না রে, যে আমায় ব্যথা দিলো না।’ অশ্রুসজল চোখে গ্রামবাংলা যেন প্রত্যুত্তরে বলে ওঠে, ‘বন্ধু, আর এক বার আসিয়া/যাও মোরে দেখিয়া/আমি নয়ন ভরে একবার দেখতে চাই।’









































