রবিবার । ডিসেম্বর ২১, ২০২৫
বাংলা টেলিগ্রাফ ডেস্ক আন্তর্জাতিক ১৬ অগাস্ট ২০২৫, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন
শেয়ার

ভারতে অভিবাসন ক্র্যাকডাউনে হাজারো মানুষ আটক, তৈরি হয়েছে ‘বাংলা’ আতঙ্ক


Demonstrators protesting

এই মাসে ভারতের কলকাতায় বাংলাভাষীদের হয়রানির প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা। ক্রেডিট: সমীর জানা/হিন্দুস্তান টাইমস

ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি বস্তির এক ময়লা সংগ্রাহক জানালেন, তাকে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও সন্তানসহ জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আসামের এক ধানচাষি বললেন, পুলিশ তার মাকে তুলে নিয়ে গেছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে কোনো খোঁজ নেই। আবার গুজরাটে এক ষাট বছরের মাজারকর্মী অভিযোগ করেছেন, তাকে চোখ বেঁধে পুলিশ মারধর করেছে এবং পরে নৌকায় তুলে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে।

এমন নানা ঘটনার পেছনে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের অভিবাসী দমন অভিযান, যা সরকার জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে চালালেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি মুসলিমদের ওপর ভয় সৃষ্টির এক পরিকল্পিত অভিযান। বিশেষত যাদের ভাষা তাদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। এপ্রিল মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর এ অভিযান আরও তীব্র হয়। যদিও অধিকাংশ আটককৃত ব্যক্তি পাকিস্তান সীমান্ত থেকে বহু দূরে বসবাস করেন।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হাজারো বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমকে আটক, কারাবন্দি কিংবা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক তরুণ বহু বছর ধরে কাজের জন্য ভারতের বড় শহরগুলোতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এবার তারা হয়ে উঠেছেন পুলিশের টার্গেট।

মধ্য জুলাই থেকে দিল্লির উপকণ্ঠ গুরগাঁওয়ে (বর্তমান গুরুগ্রাম) চলছে ‘ভেরিফিকেশন ড্রাইভ’। সেখানে শত শত বাঙালি শ্রমিককে আটক করে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ তাদের কাছে বৈধ ভারতীয় পরিচয়পত্র ছিল। কিন্তু আতঙ্কে শত শত পরিবার শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। স্থানীয় গণমাধ্যম জানায়, অন্তত ২০০–২৫০ জনকে আটক করা হলেও পুলিশের তথ্যমতে কেবল ১০ জনকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে।

অভিযানের ভয়াবহ চিত্র

বিজেপি শাসিত বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যে হাজারো কথিত রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি মুসলিমকে আটক করা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু গুজরাটেই অন্তত ৬ হাজার ৫০০ জন, কাশ্মীরে ২ হাজার এবং রাজস্থানে প্রায় ২৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। চলতি বছরের মে মাসে রাজস্থানে নতুন করে তিনটি আটক কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।

অভিজিৎ পাল, ১৮, যিনি হিন্দু, জানান তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে গুরগাঁওয়ে গিয়েছিলেন ঝাড়ুদারের কাজ করতে। তার বস্তিতে অভিযান চালানো হলে শহরের পুলিশ তাকে পাঁচদিন আটক করে রাখে, যদিও তিনি কর্মকর্তাদের রাজ্য পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলেন। তিনি আরও জানান, সামাজ কর্মীরা অতিরিক্ত কাগজপত্র দিয়ে তার ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার পরই পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। ভারতে কোটি কোটি মানুষের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার মতো কাগজপত্র নেই।

আমের শেখ, ২১, পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে রাজস্থানে নির্মাণকাজে যোগ দিয়েছিলেন। জুন মাসে পুলিশ তাকে আটক করে, যদিও তার কাছে রাজ্য আইডি কার্ড ও জন্ম সনদ ছিল—এমনটাই জানিয়েছেন তার চাচা আজমাউল শেখ। তিন দিন হেফাজতে থাকার পর থেকে পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে।

Security forces patrolled

মে মাসে আসাম রাজ্যে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে টহল দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। ক্রেডিট: বিজু বোরো/এএফপি

পশ্চিমবঙ্গে জন্ম নেওয়া ২৭ বছর বয়সী ময়লা সংগ্রহকারী দানিশ শেখকে জুনের শেষ দিকে তার গর্ভবতী স্ত্রী ও ৮ বছরের ছেলেকে সহ পুলিশ আটক করে। পাঁচ দিন হেফাজতে রাখার পর তাদের সীমান্তবর্তী জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে হেঁটে যেতে বলা হয়। ভারতের কয়েক দশক পুরোনো জমির কাগজপত্র ও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আইডি কার্ড থাকা সত্ত্বেও তখন থেকে তারা সেখানেই আটকে আছেন। দানিশ শেখের স্ত্রী সোনালী খাতুন বলেন, আমরা জানি না, কবে বাড়ি ফিরতে পারব।

ইমরান হোসেন নামে আরেক ভারতীয় নাগরিক জানান, গুজরাট রাজ্যে পুলিশ তার মহল্লায় অভিযান চালালে তাকে চোখ বেঁধে বেধড়ক মারধর করা হয় এবং নৌকায় তুলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাতের ঘুম এখন তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, আমি যখন ঘুমাতে যাই, তখনও মানুষের কান্নার শব্দ শুনতে পাই।

মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ইতোমধ্যেই অনেক ভারতীয় নাগরিক, যাদের ভুলভাবে বাংলাদেশি হিসেবে বিতাড়িত করা হয়েছিল, তাদের ফেরত নিতে বাধ্য হয়েছে ভারত সরকার।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভারতের শাসক দল বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের অভিযোগ তুলে আসছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা সাম্প্রতিক অভিযানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, সীমান্ত পেরিয়ে অনিয়ন্ত্রিত মুসলিম অনুপ্রবেশের কারণে ভয়াবহ জনমিতিক পরিবর্তন ঘটছে।

তবে সমালোচকরা বলছেন, এ অভিযানে আইন মানা হচ্ছে না, আদালতের প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে মানুষকে তাড়ানো হচ্ছে। ফলে বৈধ ভারতীয় নাগরিকরাও ঝুঁকিতে পড়েছেন, বিশেষ করে বাংলাভাষী দরিদ্র মুসলিমরা।

ভারতের আসাম রাজ্যের কৃষক মালেক অস্তার অভিযোগ করে বলেন, তার মা ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড—সব দেখিয়েছেন। তবুও পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তারা জানেন না তিনি এখন কোথায় আছেন।

কৃষক মালেক আরও যোগ করেন, আমরা কখনো বাংলাদেশে যাইনি। তবু এখন বাইরে গেলে বাংলায় কথা বলতে ভয় পাই।

পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোনো চূড়ান্ত পরিসংখ্যান দেয়নি। তবে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের দাবি, গত মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে অন্তত দুই হাজার মানুষকে ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে।

সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস