ডাম্পিং স্টেশন বা ময়লার ভাগাড়ে যেমন পরিত্যক্ত বস্তু ফেলে রাখা হয় অনেকটাই সেরকম একটার পর একটা পরিত্যক্ত উড়োজাহাজ ফেলে রাখা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ওয়ারিশ থাকলেও বেওয়ারিশের মতো ফেলে রাখা উড়োজাহাজগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিকে ‘ডাম্পিং স্টেশনে’ রূপ দিয়েছে।
ডাম্পিং স্টেশনের মতো বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো ফেলে রাখায় কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনের বিশাল অংশ দখল হয়ে আছে। এতে সেখানকার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে উড়োজাহাজগুলো থেকে বকেয়া পার্কিং চার্জও আদায় করতে পারছে না বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
অথচ কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোন থেকে পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে নিলে, সেখানে কমপক্ষে সাতটি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যেত বলে দাবি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। সেই সঙ্গে কার্গো উড়োজাহাজগুলোতে মালামাল উঠানো ও নামানো সহজ হতো। বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো পড়ে থাকলেও তা সরিয়ে নেয়ার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। অবশ্য বেবিচকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো সরাতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ ২০১২ সালের ৩০ মার্চ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের রুটের ফ্লাইট কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় বেসরকারি এয়ারলাইন্স জিএমজি। কার্যক্রম বন্ধের সাত বছর পার হলেও শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পরিত্যক্ত দুটি এমডি-৮২ উড়োজাহাজ সরিয়ে নেয়নি এয়ারলাইন্সটি।
শুধু জিএমজি নয়, কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ২২টি উড়োজাহাজ। এগুলো সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সকে তাগাদা দিয়ে একাধিকবার চিঠিও দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এরপরও এসব উড়োজাহাজ সরানো হয়নি।
শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনে ২০১২ সালের মার্চে পরিত্যক্ত দুটি এমডি-৮২ (রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এডিও, এস২এডিএম) ও দুটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ ফেলে রাখা হয়। পরবর্তীতে ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ দুটি বিক্রি করে দিলেও তা এখনও সরিয়ে নেয়া হয়নি। সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী নেতা এ উড়োজাহাজ কোম্পানির মালিক হওয়ায় কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বেবিচক।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, জিএমজি এয়ারলাইন্স ছাড়াও কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইন্সের একটি ট্রাইস্টার (রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এইটি) উড়োজাহাজ। কার্গো পরিবহনে ব্যবহৃত এ উড়োজাহাজটি ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। একইভাবে অ্যাভিয়েনা এয়ারলাইন্সের একটি ড্যাশ-৮ (রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এইএল) উড়োজাহাজ এবং বিসমিল্লাহ এয়ারলাইন্সের একটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে বেবিচকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এসব উড়োজাহাজ বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এগুলো সরিয়ে নিতে এয়ারলাইন্সগুলোকে একাধিকবার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে নিতে সময় চেয়ে আবেদন করেছে।
তিনি বলেন, কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় যারা যোগাযোগ করছে না, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া শেষে তাদের উড়োজাহাজগুলো স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বেবিচক।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তৌহিদ-উল আহমেদ জানান, পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে নিলে সেখানে কমপক্ষে সাতটি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। পাশাপাশি কার্গোগুলোতে মালামাল উঠানো ও নামানো সহজ হবে।
তিনি বলেন, পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে নিতে বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বেবিচক। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মামলাও হয়েছে।
এদিকে উড়োজাহাজগুলো সরিয়ে না নেয়ায় এয়ারলাইন্সগুলোর পার্কিংবাবদ চার্জ প্রতিনিয়ত বকেয়া হিসাবে বাড়ছে। কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া এয়ারলাইন্সগুলো থেকে এ অর্থ আদায়ও করতে পারছে না বেবিচক।
জানা যায়, ২০১২ সালের ২৯ জুন জিএমজি এয়ারলাইন্সের লাইসেন্সের (এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেশন) মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তীতে অডিটে নিরাপত্তা ঝুঁকি, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি, দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ব্যবহার করে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল বাবদ ১৩৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বকেয়া থাকায় প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স স্থগিত করে বেবিচক।
একইভাবে চালু থাকা এয়ারলাইন্সগুলোও বকেয়া পরিশোধ করছে না। গত জুন পর্যন্ত অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাবদ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে এক হাজার ৪৪৭ কোটি, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে সবমিলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে বেবিচকের।
বারবার তাগাদা দিয়েও বকেয়া আদায় করতে না পারায় সম্প্রতি এয়ারলাইন্সগুলোর বিরুদ্ধে পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি (পিডিআর) অ্যাক্ট ১৯১৩- এর আওতায় মামলা করে বকেয়া আদায়ের চেষ্টা করছে বেবিচক।
কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়া এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি চালু থাকা এয়ারলাইন্সের পরিত্যক্ত উড়োজাহাজও রয়েছে শাহজালাল বিমানবন্দরে। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি এফ-২৮ ও চারটি ডিসি-১০ (রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এসিও, এস২এসিকিউ, এস২এসিআর, এস২এসিপি) উড়োজাহাজ এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একটি ড্যাশ-৮ (রেজিস্ট্রেশন নং-এস২এএইচএ) উড়োজাহাজ কয়েক বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চারটি এমডি-৮৩ উড়োজাহাজ পড়ে আছে কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোনে, যেগুলোর রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এইইউ, এস২এইজে, এস২এইভি ও এস২এইএইচ। একই সঙ্গে প্রায় দুই বছর ধরে ইউনাইটেডের একটি ড্যাশ-৮ (রেজিস্ট্রেশন নং- এস২এইএস) উড়োজাহাজও পড়ে আছে।
বেবিচকের ল্যান্ডিং-পার্কিং ও নেভিগেশন চার্জ বাবদ প্রায় ২০০ কোটি টাকা ছাড়াও বিনিয়োগকারীদের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বিরুদ্ধে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মালিক তাসভির-উল আলম চৌধুরীকে খুঁজে পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। বেবিচকের নথিপত্রে তিনি পলাতক।
কার্গো ভিলেজ অ্যাপ্রোন এলাকা থেকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিত্যক্ত উড়োজাহাজগুলো কবে সরানো হবে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কেউ কিছু বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেয়ারম্যান তাসভির-উল আলম চৌধুরীর ঢাকা ও যুক্তরাজ্যের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার উত্তরার অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি ছয় মাসের বেশি সময় ধরে অফিসটিতে আসেন না।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ