Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

উইঘুরদের দুর্দশায় মুসলিম বিশ্ব নীরব কেন?

china-muslim-womenচীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চীনা কর্তৃপক্ষের অব্যাহত নির্যাতন ওই এলাকার ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের বিরাট হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। প্রদেশটির কাশগড় এবং উরুমকি শহরের প্রধান মসজিদগুলো জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সেখানে নামাজ আদায়সহ ধর্মকর্ম পালনের জন্য তেমন কাউকে দেখা যায় না। পুরো প্রদেশটিকে এক ধরনের জেলখানায় পরিণত করেছে কর্তৃপক্ষ। মুসলিমদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ‘আল্লাহ’কে ছেড়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভজন-পূজন করার। নামাজ ও রোজা পালন এবং ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। চীনের অন্যান্য প্রদেশেও আরবিতে কোনো লেখা প্রচার ও প্রকাশ করার ওপর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। এটা মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে একপ্রকার ভীতি সৃষ্টির আয়োজন বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক International Consortiam of Investigation Gournalists (ICIT) দ্বারা চীনা মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস পৃথিবীর অন্যান্য জনসম্প্রদায়কেও বিস্মিত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, চীনা কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসবিরোধী Re-education and training center চালানোর নামে উইঘুর জনগোষ্ঠীকে কমিউনিস্ট পার্টির দীক্ষায় দীক্ষিত করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করেছেন, তাদের কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন চীনা নির্যাতনের কথা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী, কিছু উইঘুর ওই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে।

chardike-ad

কিন্তু ওই অত্যাচারসহ মুসলিম উইঘুরদের অমানবিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এযাবৎ মুসলিম বিশ্বের নেতাদের জোরালো কোনো প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। যে মুসলিম বিশ্ব প্রতিরোধ-প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর অত্যাচার, রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে; উইঘুরদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচারের ঘটনায়ও তাদের মুখ খুলতে দেখা যায়নি। কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকেও এ ব্যাপারে জোরালো উচ্চবাচ্য করতে আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাপট এবং তার প্রভাব।

উইঘুর অধ্যুষিত জিনজিয়াং প্রদেশের সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র পাকিস্তান আজ পর্যন্ত উইঘুর প্রশ্নে অনেকটাই নিশ্চুপ। তথ্যাভিজ্ঞ মহল পাকিস্তানের এই নীরবতাকে প্রভাবশালী চীনের বিপরীতে দেশটির দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে, পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে চীনের Belt and Road Initiative Project থাকায় এবং এ জন্য বিপুল অর্থের বিনিয়োগ থাকায় চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা দেশটির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। উপরন্তু China-Pakistan Economic Corridor (CPEC) প্রকল্পে ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যদি পাকিস্তান এবং চীনের বন্ধুত্বে কোনো বিষয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেস (জেনেভা) গত সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কঠোর সমালোচনা করে বলেছে, এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক যে, উইঘুরদের ওপর চীনের নির্যাতনের বিষয়ে ইসলামাবাদ নীরবতা পালন করে চলেছে এবং বেইজিংকে এ ব্যাপারে সমর্থন দিচ্ছে। উইঘুর নেতারা বলেন, ইমরান খান এক দিকে উইঘুর প্রসঙ্গে চোখ বন্ধ করে আছেন, অন্য দিকে কাশ্মির ইস্যুতে উচ্চকণ্ঠ, যা তার দ্বৈতসত্তার প্রকাশ। ২০১৯ সালের আগস্টে আলজাজিরায় এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান নিজস্ব মত অনুযায়ী কাশ্মিরের মানুষের দুর্দশার বর্ণনা দেন এবং ভারতের বিজেপি সরকার যে কত বর্ণবাদী ও ফ্যাসিস্ট, তারও সুদীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

এ বছরের শুরুতে পাকিস্তানের অনেক সাংবাদিক এবং বিশিষ্টজন চীনের ‘উপবাস’ নিষেধাজ্ঞা নীতির সমালোচনা করেছেন। ফলে চীনের ইসলামাবাদের ডেপুটি চিফ অব মিশন লি জিয়ান ঝাউ বাধ্য হন তার দেশের পক্ষে সাফাই গাইতে। তিনি বলেন, এই নিষেধাজ্ঞা কেবল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, ছাত্র ও সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, এই নিষেধাজ্ঞা চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত সব মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য।

কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানের জনগণের কাছে চীনের চিত্রটি মলিন হয়ে গেছে এবং তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কারণ তারা জানতে পেরেছে, অল্পবয়সী পাকিস্তানি মেয়েদের চীনে বিয়ের নামে নিয়ে গিয়ে যৌন ব্যবসায় নিয়োজিত করা হয় এবং সেখানে মানব অঙ্গের ব্যবসাও ঢালাওভাবে চালানো হচ্ছে। তবে চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের অত্যাচার, তাদের ধর্ম পালনে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে, সেটি পুঞ্জীভূত হয়ে ভবিষ্যতে ক্রোধের আকার ধারণ করে পাকিস্তান সরকারকে চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে কি না, এটাই দেখার বিষয়।

গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে দেখা করেন। এর কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের আটকে রেখে যে অত্যাচার করা হচ্ছে, তার প্রতি ঔদাসীন্য দেখানোর কারণে পাকিস্তানের সমালোচনা এবং জম্মু ও কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে পাকিস্তানের প্রচারের বিরোধিতা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উইঘুর মুসলিমদের দুরবস্থার প্রতি পাকিস্তানকে ‘আরো মনোযোগী’ হওয়ারও পরামর্শ দেয়। মার্কিন বিদেশ দফতরের ভারপ্রাপ্ত সহকারী সচিব (দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়া) Allaice Wells পাকিস্তানকে কাশ্মিরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের ইস্যুতে উত্তেজনা বৃদ্ধি করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি আরো বলেন, কাশ্মিরের ব্যাপারে পাকিস্তানের যে উদ্বেগ, তার সমপরিমাণ উদ্বেগ তিনি পাকিস্তানের কাছ থেকে আশা করেন উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে; যারা চীনের বন্দিশিবিরে কনসেনস্ট্রেশন চেম্বারের মতো দিনযাপন করছেন।