আবারো বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। শুক্রবার (৫ আগস্ট)সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম রাতারাতি ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা হয়েছে। রাতে সরকারি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যবৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
অর্থাৎ নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে এক লাফে ৩৪ টাকা। অকটেনের দাম বেড়েছে লিটারে ৪৪ টাকা। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেট্রোলের দাম। প্রতি লিটারে এর দাম বাড়ে ৪৬ টাকা। শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে ভোক্তা পর্যায়ে নতুন এই মূল্য কার্যকর হয়।
এদিকে রাত ১০টায় তেলের দাম হঠাৎ বাড়ার ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের পেট্রোল পাম্পগুলোতে অরাজকতা নেমে আসে। একযোগে সব পেট্রোল পাম্প তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়। এতে তেলের জন্য রাস্তায় বিশাল লাইন তৈরি হয়। তেল না দেওয়ায় অনেক জায়গায় পেট্রোল পাম্পে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে গণপরিবহণও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জ্বালানি বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি/ক্রয়কৃত ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করে ভোক্তা পর্যায়ে এই দাম পুনঃনির্ধারণ করা হলো।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাত ১২টার পর থেকে ডিপোর ৪০ কিলোমিটারের ভেতর ভোক্তা পর্যায়ে এই খুচরা মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, জনবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় আমজনতার স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।
যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা করেনি। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই কিছুটা এডজাস্টমেন্টে যেতে হচ্ছে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা হবে।
জ্বালানি বিভাগের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতির কারণে পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত তেলের মূল্য সমন্বয় করে থাকে। ভারত চলতি বছরের ২২ মে থেকে কলকাতায় ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ৯২.৭৬ রুপি এবং পেট্রোল লিটারপ্রতি ১০৬.০৩ রুপি নির্ধারণ করেছে যা অদ্যাবধি বিদ্যমান রয়েছে।
এই মূল্য বাংলাদেশি টাকায় যথাক্রমে ১১৪.০৯ টাকা এবং ১৩০.৪২ টাকা। (১ রুপি=গড় ১.২৩ টাকা)। অর্থাৎ বাংলাদেশে কলকাতার তুলনায় ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৩৪.০৯ এবং পেট্রোল লিটারপ্রতি ৪৪.৪২ টাকা কমে বিক্রয় হচ্ছিল। মূল্য কম থাকায় তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়া সময়ের দাবি।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে (সব পণ্য) ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে যৌক্তিক মূল্য সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
এদিকে তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও বাড়ছে।
নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, দেশব্যাপী লোডশেডিং ও গ্যাস সংকটে যখন শিল্প-কারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে তখনই জ্বালানি তেল বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে সরকার।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সব প্রক্রিয়াও শেষ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ লক্ষ্যে গত ১৮ মে গণশুনানি শেষ করেছে সংস্থাটি। বিইআরসির টেকনিক্যাল কমিটি বিদ্যুতের দাম ২ দশমিক ৯৯ টাকা বাড়ানোর সুপারিশ করে।
অর্থাৎ প্রায় ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ওই কমিটি। নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সে হিসাবে চলতি মাসের মধ্যে দাম বাড়ার ঘোষণা আসতে পারে। গত ৫ জুন সর্বশেষ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। ওইদিন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়।
তাতে বাসার রান্নায় ব্যবহৃত দুই চুলায় মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা ও এক চুলায় দিতে হচ্ছে ৯৯০ টাকা। জুন মাস থেকে নতুন দর কার্যকর হয় যা জুলাই মাসে পরিশোধ করেন গ্রাহকরা। মাত্র ১ মাস যেতে না যেতে ফের গ্যাসের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে সরকার।
শুক্রবার সকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন আর রাতেই তা কার্যকর করা হয়। তিনি অবশ্য বলেছিলেন, জনগণের দুর্ভোগ হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেবে না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে তাতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠবে। বেড়ে যাবে গণপরিবহণসহ সব ধরনের পণ্যের দাম। তাদের বক্তব্য সাধারণত সপ্তাহের শেষ দিনে এ রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা। কিন্তু সরকার হঠাৎ করে বন্ধের দিন গভীর রাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিরল।
গ্যাসের দাম বাড়ানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সর্বশেষ জুন মাসে যে দাম বাড়ানো হয়েছে তা ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক দর সমন্বয় করতে গিয়ে করা হয়েছে। যুদ্ধের কারণে ওই দাম আরও অনেক বেড়ে গেছে।
এখন আবার সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এর ঘোষণা দেবে বিইআরসি। তারা ইতোমধ্যে গণশুনানি গ্রহণ করে পরবর্তী কার্যক্রম শেষ করে এনেছে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে দর ঘোষণা করতে পারে।
বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ বজলুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুযায়ী শুনানির পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কমিশনে এখন সর্বশেষ পর্যালোচনা চলছে।
গত ৭ জুলাই গণমাধ্যমে পাঠানো এক অডিওবার্তায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
এর আগেও ১৪ জুন এক অনুষ্ঠানে একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। তার বক্তব্য-যে তেল আমরা ৭০ থেকে ৭১ ডলারে কিনতাম সেটা ১৭১ ডলার হয়ে গিয়েছিল। যদিও এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩৪ ডলারে।
৭৯ ডলারের ওপরে গেলেই লোকসান গুনতে হয়। আর গ্যাসের যে ঘাটতি ছিল গ্যাসে সেটা আমরা ইমপোর্ট গ্যাস দিয়ে পূরণ করতাম। এর মধ্যে ছিল লংটার্ম কনট্যাক্ট ও শর্টটার্ম কনট্যাক্ট। লংটার্মের প্রাইসটা ফিক্স করা।
তুলনামূলক এই দামটা তেলের সঙ্গে ওঠানামা করে। আরেকটা হলো-স্পট মার্কেট। এই মার্কেটের ডিমান্ড বেড়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল এবং গ্যাসের দাম প্রচণ্ডভাবে এফেক্ট করেছে।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষ যখন তীব্র মূল্যস্ফীতির সঙ্গে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, তখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো। একই সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে আবারও বাড়বে পরিবহণ ব্যয়।
পরিবহণ খরচ বৃদ্ধির কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দামও বাড়বে। কৃষি, শিল্প উৎপাদনসহ তেলের মূল্যবৃদ্ধি হলে অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে।
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে।
ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব এবং পরবর্তী সময়ে যদি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় তাতে সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে জ্বালানি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা গত ২৭ জুন পরিবহণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের অস্থিতিশীলতার কারণে জুনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতিদিন গড়ে ১০০ কোটি ১৮ লাখ টাকা করে লোকসান করছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো বিকল্প নেই। জ্বালানি তেলের দাম ১০, ২০ অথবা ৩০ টাকা বাড়ানো হলে পরিবহণ খরচ কত বাড়তে পারে, বৈঠকে এ সংশ্লিষ্ট একটি বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়।
গত নভেম্বরে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ফলে সরকার গণপরিবহণের ভাড়া কত টাকা বাড়িয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করে এই প্রাক্কলন করা হয়। যদি ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানো হয়, তাহলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে স্বল্প দূরত্বের বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে বেড়ে ২ টাকা ২৩ পয়সা হবে।
দূরপাল্লার বাসের ক্ষেত্রে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ১ টাকা ৮৯ পয়সা হবে। একইভাবে ডিজেলের দাম ২০ ও ৩০ টাকা বাড়ানো হলে পরিবহণ খরচ প্রতি কিলোমিটারে যথাক্রমে ১৬ পয়সা ও ২৪ পয়সা করে বাড়বে।
তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের মতে, পরিবহণ সংস্থাগুলো কখনোই সরকারের নির্ধারিত ভাড়া মানে না। এতে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েই যাতায়াত করতে হয়।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, পরিবহণ মালিকদের সঙ্গে এটি ছিল প্রাথমিক বৈঠক। তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে। কারণ তেলের দাম বাড়ালে পরিবহণগুলো অনেক বেশি ভাড়া আদায় করে।
এতে দেশে নৈরাজ্য তৈরি হবে। এজন্যই পরিবহণ মালিকদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে। কিন্তু হঠাৎ করে আর কোন বৈঠক না করেই শুক্রবার বন্ধের দিনে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো রহস্যজনক বলে মনে করছেন খোদ পরিবহণ মালিকরা। তারা বলেছেন, এখন যদি পরিবহণ খাতে কোনো নৈরাজ্য তৈরি হয় সেজন্য পরিবহণ মালিকরা দায়ী থাকবেন না। এজন্য সরকারই দায়ী থাকবে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিপিসি বা জ্বালানি বিভাগের তেলের দাম নির্ধারণের কোনো এখতিয়ার নেই।
জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে বিপিডিবির।