কূটনীতিক ওয়ালিদ ইসলাম ৩৫তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে চাকরি পান। পুরুষ পরিচয়ে চাকরি পাওয়া ওয়ালিদ ২০২১ সালের জুনে ইরানের তেহরান দূতাবাসে যোগ দেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ বাস্তব জীবনে ছিলেন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া)। দূতাবাসে যোগদানের পর জেন্ডার পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু করেন তিনি। একপর্যায়ে হরমোনজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। এ অবস্থায় তার জেন্ডার পরিবর্তনসহ জটিল অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১৬ লাখ টাকা। এ টাকার পুরোটাই তেহরানে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফান্ড থেকে নেন তিনি। তবে কূটনীতিক ওয়ালিদের জেন্ডার পরিবর্তনসহ জটিল চিকিৎসার খরচের অনুমোদন দেয়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিষয়টি নিয়ে অডিট আপত্তি উঠেছে, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
জানা যায়, ২০২২ সালের জুলাইয়ে ওয়ালিদ তেহরান দূতাবাসের প্রথম সচিব থাকাকালে জেন্ডার পরিবর্তনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেন। পরে একই মাসে ইরানের তখনকার রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গাউসুল আজম সরকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তার জেন্ডার পরিবর্তনের অনুমোদন চেয়ে একটি ফ্যাক্স পাঠান। তবে মন্ত্রণালয় থেকে সাড়া দেওয়ার আগেই রাষ্ট্রদূতের মৌখিক অনুমোদনের ভিত্তিতে ২০২২ সালের অক্টোবরে ওয়ালিদ ইসলাম তার জেন্ডার পরিবর্তনের জন্য সার্জারি করেন। এতে প্রায় ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়। আর এই পুরো টাকাই তিনি দূতাবাস থেকে নেন। এভাবে রাষ্ট্রীয় খরচে জেন্ডার পরিবর্তনের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। পরে খরচের এই বিষয়টি নিয়ে দূতাবাসের ২০২২-২৩ অর্থবছরে অডিট আপত্তি ওঠে।
জানতে চাইলে কূটনীতিক ওয়ালিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুরুষ হিসেবে আমি পড়ালেখা করেছি সত্য। তবে আমার জেন্ডার সম্পর্কিত সমস্যা ছিল। আমার ভেতরে ইউরেটাস ছিল বা সেটা ফ্লারিশ ছিল না। সেজন্য সার্জারি করতে মন্ত্রণালয়ে টাকা চেয়ে আবেদন করি। আবেদনে আমি বলেছিলাম, আমি আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগছি। আমি একজন ফিমেল হতে চাই; কিন্তু মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়নি। পরে আমার কোলন ক্যান্সারসহ আরও বেশ কিছু জটিলতা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে কয়েকটি অপারেশন হয় এবং আমার সেক্সুয়াল গ্ল্যান্ট কেটে ফেলি। আমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছি, বিষয়টি পুরোপুরি তেমন না। তখন রাষ্ট্রদূতের মৌখিক অনুমোদনক্রমে আমি দূতাবাস থেকে টাকা নিয়েছিলাম। এখন অডিট আপত্তি উঠেছে এবং সেটা নন-এসএফআই করে রেখেছেন।’
এ ব্যাপারে বক্তব্য নেওয়া হয় তখনকার তেহরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এ এফ এম গাউসুল আযম সরকারের। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে জনসম্মুখে আলোচনা (পাবলিকলি ডিসকাস) করতে চাই না। মৌখিক অনুমোদন নিয়ে টাকা খরচের যে কথা বলা হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। এটি সরকারের নিয়মের বিষয়।’
ওয়ালিদ ইসলামের জেন্ডার পরিবর্তন-সংক্রান্ত অডিট আপত্তির বিষয়ে তেহরান দূতাবাসের কর্মকর্তা মোল্লা আহমদ কুতুবদ দ্বীনের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (সংস্থাপন) বরাবর লেখা এক চিঠি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ দূতাবাস, তেহরানের ২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষাকালে নিরীক্ষা দল ওয়ালিদ ইসলাম, প্রথম সচিব (লোকাল) কর্তৃক তার চিকিৎসা বাবদ ব্যয়িত ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৭৪০ টাকার নিরীক্ষা আপত্তি উত্থাপন করেছে। নিরীক্ষা দলের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মিশনে কর্মরত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জটিল ও দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার (লিঙ্গ পরিবর্তনসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসা) জন্য কোনো সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও ওয়ালিদ ইসলামকে জটিল ও দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসার জন্য সরকারের অনুমোদন ব্যতিত অনিয়মিতভাবে চারটি বিলের মাধ্যমে ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৭৪০ টাকা পরিশোধ করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ওয়ালিদ ইসলামের দাবি অনুযায়ী দূতাবাসে যোগদান করার আগে থেকেই তার হরমোনজনিত সমস্যা ছিল; কিন্তু মিশনে যোগদান করার পর তার সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে এ সমস্যাজনিত কারণে তার রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম ও তার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম আক্রান্ত হয়। তিনি সে সময় হাসপাতালে ভর্তি হন এবং স্থানীয় ডাক্তাররা তাকে যত দ্রুত সম্ভব হরমোনাল গ্লান্ড ফেলে দেওয়াসহ লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অপারেশন করার পরামর্শ দেন। ওয়ালিদ ইসলামের চিকিৎসা-সংক্রান্ত ডকুমেন্ট পর্যবেক্ষণ ও তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি ২০২২ সালের ১ অক্টোবর লিঙ্গ পরিবর্তন-সংক্রান্ত একটি মেজর অপারেশন করেছেন। ওয়ালিদ ইসলামের দাবি অনুযায়ী লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অপারেশন করা জরুরি ছিল বিধায় তৎকালীন রাষ্ট্রদূতের মৌখিক অনুমোদনক্রমে অপারেশন করা হয়।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দাবি অনুযায়ী, গত ১৭ আগস্ট ২০২২ তার কলোস্টমি, রেক্টোভাজাইনাল ফিস্টুলা এবং নাকের সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি অপারেশন করানো হয়। রিপোর্টে বলা হয়, সাবেক রাষ্ট্রদূত ২০২২ সালের ২৭ জুলাই ওয়ালিদ ইসলামের লিঙ্গ পরিবর্তন সংক্রান্ত চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সাধারণ অনুমোদন চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ জানান। মন্ত্রণালয়ের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি।