Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদী দাবানলের জন্মদাতা আমেরিকা

গত ১৩ বছর ধরে ইরাকে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের দাবানল নিভে যাবার কোন আশু সম্ভাবনা নেই। এটা গ্রাস করতে উদ্যত মধ্যপ্রাচ্যকে। কেন এমন হলো?

মধ্যপ্রাচ্য বলতে পশ্চিমে মিশর, তুরস্ক, সাইপ্রাস এবং পূর্বে পারস্য উপসাগর। ১৯৮০-৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধে নিহত প্রায় ১০ থেকে ১২ লক্ষ। ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তুরস্ক-কুর্দিস্তানের জঙ্গীদের যুদ্ধে নিহত প্রায় ৫০হাজার। ১৯৯০-৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাক-কুয়েত-সৌদি আরবের লোক নিহত প্রায় ৪০ হাজার। ১৯৯৮ সালে ইরাকের ওপর মার্কিন ও পশ্চিমীদের বোমাবর্ষণে নিহত প্রায় ২হাজার। ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট সশস্ত্র জঙ্গীদের আরোপিত গৃহযুদ্ধে ১.৫ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ নিহত। জাতিসংঘের সমস্ত বিধান লঙ্ঘন করে ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমেরিকার মদতে ইসরাইল প্যালেস্তিনীয়দের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ জারি রেখেছে। তাতে নিহত প্রায় ২৫হাজার। কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী তুরস্ক থেকে আরব সাগরের পারস্য উপসাগরের আরব আমিরাত, দক্ষিণে লোহিত সাগর তীরবর্তী সৌদি আরব থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী ইরান, গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন প্রায় যুদ্ধক্ষেত্র -গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পশ্চিমী আগ্রাসন বা সন্ত্রাসবাদী ও মৌলবাদী তৎপরতা।

chardike-ad

middle east ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ইরাক থেকে আমেরিকান সৈন্য চলে আসার পর গত আগস্ট মাসে আমেরিকা আবার আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে। এবার আক্রমণের লক্ষ্য মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদী ‘ইসলামিক স্টেট’-র (আই এস) ঘাঁটির ওপর আক্রমণ। প্রত্যেক যুদ্ধ-আগ্রাসনে আমেরিকার একটা অজুহাত থাকে। এবারের অজুহাত ইয়েজিদি সংখ্যালঘুরা আইএস-এর হাতে আক্রান্ত হচ্ছে। সেজন্যই সামরিক হস্তক্ষেপ! ২০০৩সাল থেকে ইরাক আমেরিকার অধিকৃত থাকার সময়ে আল-কায়েদা উত্তর ইরাকে তাদের তৎপরতা শুরু করে। আরব দুনিয়ার সর্বত্রই এই মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলি আমেরিকা এবং তাদের পছন্দের আরব দেশগুলোর হাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে আমেরিকা ও তাদের এই মিত্ররা মিতালিতে আবদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে এই মার্কিন নীতি এখন জাল বিস্তার করেছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে; মধ্য এশিয়ায়, এমনকি আমাদের উপমহাদেশে।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা ইরাক-সিরিয়ায় আইএস-কে পরাস্ত করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেছেন। তার জন্য ‘পালটা-সন্ত্রাসবাদ’ চলবে। মার্কিনী অভিযানের শরিক হতে ওবামা আরবের মুসলিম যুবদেরকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ঘটলে তবেই মুসলিম যুবরা সন্ত্রাসের বিকল্প সৃষ্টি করতে পারবে। আমেরিকার পাশে যেসব আরব দেশ আছে যেমন সৌদি আরব, কাতার, মিশর, জর্ডান, বাহরাইন, তিউনিসিয়া; সেখানকার যুবকরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মার্কিনী বিকল্পে কি বিন্দুমাত্র কোনো সাড়া দেবে? কারণ এসব দেশে মৌলিক মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার বিন্দুমাত্র চিহ্নও নেই। এটা বুঝতে আরব জনগণের কোনো ভুল হয় না -যে বিষাক্ত মতাদর্শ আমেরিকা এবং তার পশ্চিমী ও আরব মিত্ররা ছড়ায় তা সন্ত্রাসবাদী-মৌলবাদী আইএস, বোকোহারাম, আল কায়েদা বা অন্যান্য গোষ্ঠীগুলির স্লোগান থেকে খুব একটা পৃথক নয়। বরং এরা সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট। ইসলাম ধর্মকে আইএস যেভাবে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদী উদ্দেশ্যসাধনে লিপ্ত হয়েছে এই ধর্মীয় বিকৃতিসাধনের নজির অন্যান্য দেশেও রয়েছে। দশকের পর দশক ধরে মুসলিম জনসাধারণকে বিপথচালিত করতে এই মৌলবাদের প্রচারক ও শিক্ষকরা বিকৃত ইতিহাস ও ভাবনা প্রচার করে আসছে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা, যারা এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারাও দাপিয়ে একইরকম বিকৃত ইতিহাস, দর্শন ও মতবাদ স্বাধীনতাপূর্ব সময়কাল থেকে প্রচার করে আসছে।

ওবামা এবং মার্কিন প্রশাসন এ ব্যাপারে সবসময়ে নীরব। বাহেরিনের আল-খলিফা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে দমিয়ে রেখেছে। আরব জগতে এরকম অবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন দেশে। তাতে মদত জোগায় মার্কিন প্রশাসন। কারণ এই গণতন্ত্র-নিধনকারীরা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী নীতির অন্ধ পৃষ্ঠপোষক। যে ইরাকে কোনো ধর্মীয় বিরোধ ছিল না, অন্য সমস্যা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিঘ্ন ঘটেনি সেখানে ইরাকের যুদ্ধ চাপিয়ে ইরাকী সমাজকে ধর্মীয় বিভাজনের সংঘর্ষে লিপ্ত করেছে আগ্রাসী আমেরিকা। শিয়া-সুন্নির আত্মঘাতী সংঘর্ষে যেমন বহু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, লক্ষ লক্ষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তখন অন্যদিকে উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তান তেল সম্পদের লাভের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ইরাকী প্রশাসনের সঙ্গে যুদ্ধ সংঘর্ষে লিপ্ত। ২০১২ সালের শেষদিক থেকে সুন্নি অধ্যুষিত উত্তর পশ্চিম ইরাকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রায় রোজই বিক্ষোভ সমাবেশ ঘটে চলেছে। সিরিয়া সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে ইরাকে বিদ্বেষের পরিস্থিতি আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয় আল কায়েদা এবং আই এস তার থেকেই শক্তি সঞ্চয় করেছে। এটা নতুন ঘটনা নয়, অনেকদিন ধরেই চলছে।

বিভিন্ন দেশের এই মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠিগুলিকে ইসলামপন্থী ‘বিরোধী’ হিসেবে সিরিয়ায় বাশের আল-আসাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে আমেরিকা এবং পশ্চিমীরা ব্যবহার করেছে; অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছে। সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ককে এই কাজে আমেরিকা নিয়োজিত করেছে। এতেই পুষ্ট হয়েছে আই এস (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া)। গত ৫ই জুন আই এস শুরু করে তাদের সশস্ত্র অভিযান। উত্তর ইরাকের অনেকগুলি শহর এবং এলাকা তারা দখল করে নিয়েছে। তারা এগোচ্ছিল বাগদাদ দখলের জন্য। আমেরিকার বসানো ইরাকী সরকার এর মোকাবিলায় নাজেহাল হয়ে পড়েছে। সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসারও ইরাকী সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে। মার্কিন পৃষ্ঠপোষিত ইরাকী সরকার সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সুন্নি মৌলবাদী আই এস-কে মদত জোগাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হাজার হাজার সংখ্যালঘু ইয়েজিদি, খ্রীষ্টান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের কারা হত্যা করেছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে, মহিলাদের ধর্ষণ ও খুন করেছে। কয়েক লক্ষ লোক ঘরছাড়া এবং অন্য দেশে পালিয়ে গেছে।

আইএস সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের উভয়দিকে বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র-বোমা দিয়ে অভিযান চালাতে ওবামার প্রকাশ্য সম্মতিদানের ঘোষণার কয়েকঘণ্টার মধ্যে রাশিয়া, ইরান ও সিরিয়া আমেরিকাকে এই বলে সতর্ক করে দেয় যে এই অভিযান যদি হয় তবে সেটা হবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ও সিরিয়ার ওপর আগ্রাসন। গত ১৫বছর ধরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন বা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার তোয়াক্কাই করেনি আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ। যেমন সার্বিয়ার ওপর বোমা বর্ষণ, সার্বিয়া থেকে কসভোকে বিচ্ছিন্ন করা, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের প্রকাশ্য মদতদান, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকা সন্দেহভাজনদের ওপর সি আই এ-র অত্যাচার, গোটা পৃথিবীর সবদেশে শাসক-রাজনৈতিক দল ও মার্কিন জনগণের ওপর জাতীয় নিরাপত্তার নামে গোয়েন্দাগিরি। কিন্তু আবার আন্তর্জাতিক আইনের নাম করে ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে আমেরিকা। সিরিয়ার পশ্চিমী মদতপুষ্ট বিরোধী জঙ্গীবাহিনী আমেরিকার সিরিয়া অভিযানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। ২২টি আরব রাষ্ট্রের মধ্যে বা ‘ঐশ্লামিক সহযোগিতা সংগঠন’-র ৫৭টি দেশের মধ্যে সৌদি আরবসহ ৫টি মার্কিন পৃষ্ঠপোষিত আরব রাষ্ট্র এই অভিযানের প্রতি সমর্থন জানায়। এই ৫টি দেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ‘ইচ্ছুকদের কোয়ালিশন’ সিরিয়ায় আল-আসাদ সরকারকে হটাতে আইএস তৈরি করে। সিআইএ তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। অঢেল অস্ত্র তাদের সরবরাহ করা হয়ে আসছে। চীন সিরিয়ার জাতীয় সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছে। জার্মানি এই মার্কিনী অভিযানে অংশ নিতে অস্বীকার করেছে। পৃথিবীর অন্যত্রও উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদ। ফলে বিশ্ব জনমত ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-র নামে আমেরিকার এই হস্তক্ষেপের বিরোধী।

সিরিয়ার আমেরিকার হয়ে যারা সন্ত্রাসবাদী কাজে যুক্ত তাদের মধ্যে আইএস ছাড়াও আছে আল কায়েদা, আল নুসরা এবং সৌদি আরব ও কাতার রাজত্বের সমর্থিত আহ্রার-আল-সাম এবং ইসলামিক ফ্রন্ট। আইএস সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ২০ জন ভারতীয় আছে বলে কূটনীতিকদের হিসেব। আত্মঘাতী বোমায় তার মধ্যে একজন ভারতীয় নিহত হয়েছে। এছাড়া ইউরোপের কিছু লোকও এরসঙ্গে যুক্ত। এই সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে পৃথক বোঝাপড়া আছে, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত।

সিরিয়ার সরকার উল্টানোর জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবাদের এই জাল বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে আমেরিকাই। ইরাক এবং আফগানিস্তানে মার্কিনী আগ্রাসন ও সন্ত্রাসবাদের আগুন নেভেনি। বরং এই সন্ত্রাসবাদ বিভিন্নভাবে আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে। এমনকি আমেরিকার জোরাজুরিতে কাতার দোহায় তালিবানদের অফিস খুলতে দিয়েছে। তালিবানদের সঙ্গে আমেরিকার বোঝাপড়ার পর্ব এখনও চলছে, যাতে গোটা অঞ্চলে আমেরিকা নিরুপদ্রব ও স্থায়ীভাবে থাকতে পারে। এটা ভারতের পক্ষেও বিপজ্জনক। নরেন্দ্র মোদী ভোটের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন। আমেরিকার কাছে নতজানু হয়ে এই হুঙ্কার অসার। ভারতের সামনে সন্ত্রাসবাদ ও সার্বভৌমত্বের বিপদ রুখতে হলে  আমেরিকার প্রতি আত্মসমর্পণের নীতি পরিত্যাগ করতে হবে।

আইএস সন্ত্রাসবাদীদের ছুরিতে ইরাকের দুই জন মার্কিন সাংবাদিকের মুণ্ডচ্ছেদের ঘটনাকে মার্কিন প্রশাসন তাদের আগ্রাসী নীতির প্রতি সমর্থনের জন্য ব্যবহার করে। আইএস যে ধরনের তালিবানি রাজত্ব চায়, অনেকটা সেই ধরনের বর্বরতা সৌদি আরব, কাতারের মতো তেল সম্রাটদের দেশে ইতিমধ্যেই চালু আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পৃষ্ঠপোষিত এই স্বেচ্ছাচারী শাসকেরা জনগণের ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও বিরোধী গণতান্ত্রিক দলগুলির অধিকারের বিরুদ্ধে। আরবের যে কোন গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ আন্দোলন দমনের জন্য সন্ত্রাসবাদী-মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলিকে অর্থ, অস্ত্র ও রসদ দিয়ে সহায়তা দেয় এই শেখ রাজত্বগুলি। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও অস্থিরতা সৃষ্টির শক্তিগুলিকে এরা মদত জোগায়। ১৯৮০-র দশকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদী নাশকতা চালানোর জন্য সিআইএ-র মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং হাজার হাজার কোটি ডলার দেয় তা দিয়ে পাকিস্তানের আইএসআই লাভবান হয়; জম্মু-কাশ্মীর এবং পাঞ্জাবে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাতে তারা বিভিন্ন অভিযান চালায়। প্রতিবেশী বাংলাদেশও এই ধরনের সহায়তার জোরে মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি হয়েছে।

যুদ্ধ-শিল্প ছাড়াও আমেরিকায় বিরাট বিরাট কোম্পানি গড়ে তুলেছে ‘সন্ত্রাসের-বিরুদ্ধে-যুদ্ধ’ শিল্প। অস্ত্রশস্ত্র, আধুনিক প্রযুক্তির সরঞ্জাম, আকাশ থেকে হামলা করার বিশেষ বিমান, বেসরকারি ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী সবকিছুই এই বেসরকাররিসামরিক শিল্পের হাতে মজুত আছে। যতই মার্কিনী হস্তক্ষেপ বাড়বে এই কোম্পানিগুলির ব্যবসা ততই তেজি হবে। যে প্রেসিডেন্টই হোক আমেরিকার নীতির ওপর এই কোম্পানিগুলির রয়েছে প্রবল নিয়ন্ত্রণ। আমেরিকার সামনে বিপদের হুজুগ তোলার জন্য রয়েছে এই কোম্পানিগুলির হাতে শক্তিশালী মিডিয়াও। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর জন্য মার্কিন কংগ্রেসও প্রেসিডেন্টের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেয়। দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এই একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রয়োগে ওবামা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে।

কিন্তু যতই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে অন্যদেশে মার্কিনী হস্তক্ষেপ বাড়ছে সেসব দেশে মার্কিন বিরোধী মনোভাবও ততই তীব্র হয়ে উঠছে। এই ক্ষোভ থেকেই শক্তি সঞ্চয় করছে মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীরা। আফগানিস্তানের আমেরিকান মদতপুষ্ট মুজাহিদিন থেকে তালিবান আল কায়েদা যেমন তৈরি হয়েছে একইভাবে আই এস তৈরি হয়েছে তথাকথিত সিরিয়ান ‘বিরোধী-বাহিনী’ থেকে। লেবাননের হিজবুল্লা সংগঠন বলেছে তারা আইএস এবং সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষিত ‘তাকফিরি’র বিরুদ্ধে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর সব সন্ত্রাসবাদের জন্মদাতা এবং হিজবুল্লা মার্কিন কর্তৃত্বাধীন পাঁচ আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যে কোয়ালিশন ইরাক ও সিরিয়া হস্তক্ষেপের জন্য সন্ত্রাসবাদকেই জোরদার করছে। ২০১১ সাল থেকে ২.৩০ কোটি লোকের দেশ সিরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীরা গৃহযুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ায় দেড় লক্ষ সিরিয়ান নাগরিক নিহত হয়েছে। সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ গৃহহীন, উদ্বাস্তু। গত ৩ জুন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রদত্ত ৭৪শতাংশ ভোটের ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাশের-আল-আসাদ নির্বাচিত হয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জন কেরি এই নির্বাচনকে ‘বিগ জিরো’ বা ‘শূন্যগর্ভ’ বলে অভিহিত করেছেন অথচ ন্যাটো নিয়ন্ত্রিত ইরাক ও আফগানিস্তানের প্রহসিত নির্বাচনকে আমেরিকা বলেছে ‘গণতান্ত্রিক’।

সন্ত্রাসবাদ দমন এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত হলো আমেরিকাকে তার আগ্রাসী হাত তুলে নিতে হবে। ওখানকার ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিই একমাত্র জনগণকে সংগঠিত করে মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের মোকাবিলা করতে পারে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করতে পারে। এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেও আমেরিকাকে হাত তুলে নিতে হবে।

সম্প্রতি জাপান ও আমেরিকা সফর করতে গিয়ে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইরাক ও সিরিয়ায় সাম্প্রতিক মার্কিনী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি। আমেরিকা-জাপান সামরিক চক্রের সঙ্গে ভারতকে যুক্ত করার চেষ্টার বিরুদ্ধেও কোনো অবস্থান তিনি নেননি। বিজেপি দলেরও মার্কিনমুখী নীতি এখন অনেক বেশি স্পষ্ট। সংসদে প্যালেস্তাইনের গাজায় মার্কিনী মদতে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আলোচনা ও প্রস্তাবে বাধা দিয়েছে বিজেপি। যেমন আর্থিক ক্ষেত্রে, তেমনি বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মোদি সরকারের মার্কিনমুখো ভূমিকা ভারতের সার্বভৌমত্বের সামনে বিপদের ইঙ্গিতবহ।

Who ever is careless with the truth in small matters cannot be trusted with important matters.- Albert Einstein.

Nothing in this world is harder than speaking the truth, nothing easier than flattery.-  Fyodor Dostoyevsky

Anything is better than lies and deceit.

– Leo Tolstoy in Anna Karenina

I can never close my lips when I have open my heart.- Charles Dickens

মৃদুল দে: ভারতীয় সাংবাদিক