Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

পিয়াসের মৃত্যু ও আমার কষ্ট

mannaসোমবার সকাল সাড়ে ৯টার সময় আসিফ নজরুল ফোন করলেন। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। আসিফ বললেন, মান্না ভাই আমি এখন পিয়াস করিম স্যারের বাসায়। ভাবী আমার সামনে। আজ একেবারে ভোরে পিয়াস ভাই মারা গেছেন।

অবিশ্বাস করার প্রশ্ন নয়। এত বড় একটা খবর নিয়ে কেন, সাধারণভাবেও রসিকতা করার সম্পর্ক নয় আমার আসিফ নজরুলের সঙ্গে। তবুও কিছু ব্যাপার থাকে যা মানুষের ভাবনার মধ্যে থাকে না। ওই রকম একটা ব্যাপার বাস্তবে সামনে এসে গেলে মানুষ ধাক্কা খায়। ধাতস্থ হতে সময় লাগে। আমারও সে রকম হলো। পিয়াস করিমকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনি না। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিতে ব্যস্ত তখন পিয়াসও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। স্বাভাবিক, সে আমাকে চিনত। আমি তাকে চিনতাম না। কারণ ও সক্রিয় ছাত্ররাজনীতি বা সে রকম কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিল না।

chardike-ad

বাংলাদেশের হাজারটা মানুষ যেভাবে পিয়াস করিমকে চেনে আমিও সেভাবেই চিনেছিলাম তাকে। টেলিভিশন টকশোতে দেখা হয়েছিল তার সঙ্গে এবং তখন অনেক কথা বলল পিয়াস। ও আমাকে চেনে। আমাকে ভোট দিয়েছিল ডাকসু নির্বাচনে। আমাদের প্যানেলের সাহিত্য সম্পাদক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ ওর বন্ধু। এখন নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবিরসহ ওই ব্যাচের অনেকের কথা বলল।

পিয়াস করিম নিজেও বিদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করত। সেও এখন প্রফেসর ড. পিয়াস করিম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। ভালোই তো ছিল দেশের বাইরে, ফিরে এলো কেন মরতে? এ রকম ভাবছিলাম তাকে নিয়ে। সে নিজে থেকেই বলল, আপনাদের দল করতাম না। কিন্তু আপনাদের থেকে শিখেছি অনেক কিছু। তাই দেশে চলে এলাম। যদি পারি দেশকে কিছু দিতে চাই। দেশের জন্য কিছু করতে চাই।

আমার পিয়াস করিমকে ভালো লেগে গেল। আমাদের দেশটা তো সত্যি সুন্দর। অপার সম্ভাবনার। এ দেশের মাটি ভালো, নদী, পানি, বন, সমুদ্র, সমুদ্রের তলদেশ, মাটির নিচে সব ভালো। সেই যে বলে, সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা এই তো আমার দেশ। আমাদের তো আরও এগিয়ে থাকার কথা, যেমন চীন এগিয়েছে। জনশক্তি আছে, ভালো মানুষ আছে। ভালো নেতৃত্ব দরকার। মেধার দরকার, অঙ্গীকার প্রয়োজন। পিয়াসকে তো মেধাবী বলতে হবে। ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিল। আরও তার অঙ্গীকারের কথা বলেছিল। সেটা লোক দেখানো, আমাকে শোনানোর জন্য নয়। ও তো বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের চাকরিটা ছেড়ে চলে এসেছিল। সেই পিয়াস করিম একেবারে না বলে-কয়ে হঠাৎ করে চলে গেল!

পিয়াস করিমের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল মাসখানেক আগে এনটিভির টকশোর সময়ে। দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছিল। আমরা দুজনই বিরাজমান পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট ছিলাম না। পিয়াস করিম বলছিল, এরকম তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। পরিবর্তন হবেই। পিয়াস করিম এরকম বিশ্বাস করত বলেই মনে হয়। মৃত্যুর দিন ১৩ অক্টোবর ওর রোরুদ্যমান স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমেনা মহাসিন সেই কথা বলছিলেন। পিয়াস করিম হার্টের রোগী ছিলেন। মাত্র এক বছর আগে ওকে দুটো স্ট্যান্ট পরতে হয়েছিল। ডায়াবেটিস ছিল, গ্যাসের রোগী ছিল। এসবের কিছুই জানতাম না আমি। এ ধরনের রোগীর শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে হয়। সব সময় যত্নবান থাকতে হয়। কিন্তু পিয়াস নিজের প্রতি যত্নবান ছিলেন না।

মৃত্যুর আগের রাতে পিয়াস অসুস্থ ছিলেন। বড় কিছু নয় পেটে ব্যথা ছিল, দুই তিনবার বমি হয়েছিল। স্ত্রী আমেনা মহাসিন স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তারই উদ্বেগের কারণে ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। জেনারেল ফিজিশিয়ান একজন দেখে বলেছিলেন, উদ্বেগের কিছু নেই। ড. পিয়াস করিম ভালো আছেন। ডাক্তার চলে যাওয়ার পরও বমি করেছিলেন পিয়াস। কিন্তু স্ত্রীর উদ্বেগকে তখনো গুরুত্ব দেননি তিনি। কাঁদতে কাঁদতে আমেনা মহাসিন বলছিলেন, পিয়াস আমাকে বলছিল, আমি মরব না দেশের একটা পরিবর্তন হওয়ার আগে। পিয়াস করিম কি ধরনের পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন! শেষের দিকে পিয়াস বিএনপির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে হয়তো জানে না পিয়াস কলেজজীবন থেকেই বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন সে কথা। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বামের ভাবধারা বদলে গেছে। পিয়াস সেই পরিবর্তিত। বামধারার মানুষ ছিলেন। এখানে পিয়াসের সঙ্গে আমার মিল হলো, বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের পতনের পর এর কারণ খুঁজতে খুঁজতে আমার মনে হলো, বাম চিন্তাগুলোর অধিকাংশই মহৎ এবং এর অধিকাংশই কল্পনাবিলাস। বিশাল মানবগোষ্ঠীকে একটি রেজিমেন্টের আওতায় আনা যায় না। প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষ থেকে স্বতন্ত্র। তার নিজস্ব চিন্তা আছে, উদ্বেগ আছে, কর্মপরিকল্পনা আছে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ আছে। একে জোর করে কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে আনা যাবে না। এ জন্যই গণতন্ত্রের প্রয়োজন। অবাধ ও মুক্ত মতপ্রকাশের এবং উদ্যোগ নেওয়ার স্বাধীনতা প্রয়োজন। সব মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাই অর্থনীতিতেও সবার জন্য সমান সুযোগ দরকার। এটাকেই আমি বলতে চাই নিটল গণতন্ত্র ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি। পিয়াসের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিল। তখন আমি নতুন করে নতুন ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। পিয়াস আমার সংগঠনের সদস্য হয়েছিলেন। আমি এমনকি ড. পিয়াস করিমকে আমার সংগঠনের মূল দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু পিয়াস তাতে রাজি হয়নি।

আমি যে চিন্তার কথা বললাম সেই চিন্তার সূত্র ধরে বিএনপির চৌকাঠে পৌঁছানো যায় না। পিয়াসকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম এরকম হলো কেন? পিয়াস তার দুঃখের কথা বলেছিল। গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে তার একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। গণজাগরণ মঞ্চ মনে করত পিয়াস করিম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতেন। সম্পর্কের এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, পিয়াস করিম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তার বাসার সামনে কে বা কারা দুটি বোমাও ফাটিয়েছিল। পিয়াসের অধ্যাপনার চাকরিটিও বিপদগ্রস্ত হয়েছিল। পিয়াস আমাকে বলেছে তখন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। তার চাকরি টিকে গিয়েছিল। কৃতজ্ঞ পিয়াস করিম বেগম জিয়া তার সন্তান তারেক ও তার সংগঠন বিএনপির পক্ষে কাজে হাত লাগিয়েছিলেন।

কেউ বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ করলে তিনি একজন খারাপ মানুষ বা তিনি নষ্ট হয়ে গেছেন এ রকম কথা আমি বলব না। পিয়াস আর এখন আমাদের মাঝে নেই। তাকে কেন্দ্র করে এরকম একটি বিতর্ক তুলতেও আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু আমরা সেই বিতর্ক থেকে বেরুতে পারছি না। বরঞ্চ দিন দিন সেই পাঠচক্রের গভীরে প্রবেশ করছি।

বিশেষ করে টকশোর কারণে পিয়াস করিম মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভাইবোনেরা বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর বুধবার ১১টা থেকে ১টা এই দুই ঘণ্টার জন্য তার মরদেহ শহীদ মিনারে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধার জন্য রাখা হবে। কিন্তু গতকাল সকালে পত্রিকায় দেখলাম তাতে আপত্তি জানিয়েছেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারা শহীদ মিনারে পিয়াস করিমের মরদেহ নেওয়া হলে প্রতিহত করবে বলে ঘোষণাও দিয়েছে। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেছেন পিয়াস করিম। তাই তার মরদেহ শহীদ মিনারে আনতে দেওয়া হবে না। পিয়াস করিম কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করতেন? বাংলাদেশে এমন কেউ কি আছেন যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরোধিতা করতে পারবেন? আমার মনে হয় না। এত বড় যে দল বিএনপি তার দুই নেতা এই বিচারের আসামি হিসেবে দণ্ডিত হয়েছেন। একজন তো মারাই গেছেন কিন্তু তারাও এ বিচারের বিরোধিতা করতে পারেননি। হ্যাঁ এ বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে পিয়াস করিম আছেন, শাহরিয়ার কবিররাও আছেন। বিদেশি অনেকে তো আছেনই।

বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কাদের কবরস্থ করা যাবে, তার একটা বিধান তো আছেই। শহীদ মিনারে কাদের মরদেহ নেওয়া হবে তার কোনো বিধান কি আছে? কে ঠিক করে সেটা? যাই হোক পিয়াস করিম কোনো জাতীয় নেতা ছিলেন না। আমি বলেছি তাকে আমি পছন্দ করতাম। তার লাশ নিয়ে যে এরকম টানাটানি হতে পারে তা ভাবতেও পারিনি, আমার কষ্ট লাগছে।

লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌজন্যে।