Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

নীলও না, সাগরও না, তবুও নীলসাগর!

nill-sagor

নীলও না, সাগরও না, তবুও জায়গাটি ‘নীলসাগর’ নামেই পরিচিত। জানা-অজানা বাহারি গাছঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশাল এক দিঘির নাম নীলসাগর। পর্যটনের জন্য সম্ভাবনাময় নীলফামারী জেলার অন্যতম পিকনিট স্পট বা বিনোদন কেন্দ্র এটি।

chardike-ad

নীলসাগরের নামকরণের সঠিক কোনো তথ্য না থাকলেও কথিত আছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্ষিবরাজার অগণিত গরু-মহিষের পানির চাহিদা মেটাতে প্রায় ৫৪ একর জমিতে খনন করা হয় এই দিঘি। মেয়ে বিন্নাবতীর নামানুসারে দিঘিটির নাম দেওয়া হয় ‘বিন্নাদিঘি’। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের উদ্যোগে এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিন্নাদিঘির নাম পরিবর্তন করে ‘নীলসাগর’ রাখা হয়।

নীলসাগরের বিশাল দিঘির চারদিকে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। পানি আর সবুজ মিলে সে এক অপরূপ দৃশ্য! সবুজ ছায়া ঘেরা দিঘির চারপাশ বাঁধানো। শান বাঁধানো দিঘির চারপ্রান্তে রয়েছে সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো ঘাট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও দিঘির পাড়ে দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে বিশ্রামের জন্য বসার জায়গা। শিশুদের জন্য সীমিতসংখ্যক দোলনা, নাগরদোলার ব্যবস্থাও রয়েছে। শীতকালে সাইবেরিয়াসহ শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে আসা অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয় ওঠে পুরো এলাকা। এটিই মূলত নীলসাগরের প্রধান আকর্ষণ। মাঝপুকুরে বসে ভিনদেশি হাজার পাখির মেলা। দিঘিতে ফোটে শাপলা। শাপলার ভাসমান পাতার ওপর পাখিদের ওড়াউড়ি অসাধারণ এক প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্ম দেয়। যা নীলসাগরে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। অপূর্ব এ দৃশ্য দেখতে শীতকালে এখানে ছুটে আসেন নানা বয়সের মানুষ।

কল্পকাহিনি ঘেরা নীলসাগরে প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তিতে বসে বারুনীর মেলা। মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় কয়েক দিনের জন্য হলেও এলাকায় চাঞ্চল্য বাড়িয়ে দেয়। জায়গাটি ঘিরে অসংখ্য জনশ্রুতি রয়েছে। যেমন শোনা যায়, ১৯৯৩ সালে সংস্কারের সময় দিঘির তলদেশে পাওয়া গিয়েছিল স্বর্ণ, রৌপ্য এবং কষ্ঠিপাথরের মূল্যবান মূর্তি। তবে মজার ব্যাপার হলো, মাটির তলদেশে মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেখানে বাস করতো বিশাল আকৃতির দুটি মাছ। ডুবুরিরা এই মন্দিরের ভেতরে যেতে পারেননি। কারণ, তাদের নাকি অলৌকিকভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছিল।

nill-sagor2nill-sagor3

আরো শোনা যায়, অনেক দিন আগে নীলসাগরের পানি শুকানোর জন্য পানি নিষ্কাশন যন্ত্র বসানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে নাকি পানির উচ্চতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতীতে গ্রামের লোকজন বিন্নাদিঘির পানিতে গাভীর প্রথম দুধ উৎসর্গ করতেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুধ চক্রাকারে ঘুর্ণায়মান অবস্থায় দিঘির মাঝখানে চলে যেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, এতে গাভীর দুধ বেশি হবে এবং অনিষ্টকারীর দৃষ্টি থেকে গাভীটি রক্ষা পাবে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, দিন দিন মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি এবং জনপ্রিয়তা বাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নীলসাগরে। মিলেছে সরকারি স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালের ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফ নীলসাগরকে ‘পাখির অভয়ারণ্য’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন।

নীলসাগরে প্রবেশ ফি জনপ্রতি ৫ টাকা। এখানে অর্থের বিনিময়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রাত যাপনের জন্য রয়েছে রেস্ট হাউস। জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে আপনি সেখানে রাতে থাকতে পারবেন। ২ কক্ষবিশিষ্ট রেস্ট হাউসে ২৪ ঘণ্টার জন্য সিঙ্গেল বেডরুমের ভাড়া ২০০ এবং ডাবল বেডরুমের ভাড়া ৪০০ টাকা। তবে খাবার জন্য এখানে আলাদা কোনো রেস্টুরেন্ট নেই।

জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও আশানুরূপ উন্নয়ন হয়নি নীলসাগরের। বরং যেটুকু রয়েছে, সেটুকুও নষ্ট হতে বসেছে অযত্নে। রাস্তা সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খাবার পানির জন্য নেই টিউবওয়েল। বিনোদনের জন্য মানুষ এলেও নেই পর্যাপ্ত বিনোদনের পরিবেশ। সীমানা প্রাচীরের অবস্থা নাজুক হওয়ায় বাইরে থেকে নীলসাগর দেখা যায়। দিঘিতে ভেসে বেড়ানোর জন্য স্পিডবোট থাকলেও সেগুলো অকেজো হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের বিনোদনের জন্য আলাদাভাবে তেমন কিছুই গড়ে ওঠেনি নীলসাগরে। যে দোলনা ও নাগরদোলা রয়েছে, তাও ব্যবহারের উপযোগী নয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নিরাপত্তার অভাব। যদিও নীলসাগরে নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছেন। কিন্তু সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অরক্ষিত প্রাচীরের কারণে অনেক সময়ই নীলসাগরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটায় দুর্বৃত্তরা। এর আগে গাছ চুরির মতো ঘটনাও ঘটেছে নীলসাগরে।

নীলসাগরের প্রবেশ পথে গড়ে উঠেছে কয়েকটি দোকান। এমনই একটি দোকানের মালিক আলমগীর হোসেন জানান, সারাদিন ৩০০ টাকাও বিক্রি হয় না। অথচ বড় আশা করে তিনি দোকান দিয়েছিলেন। দোকানিরা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, লোকজন এখানে কেন আসবে? কি আছে দেখার? একবার যারা এসেছেন, তারা আর কখনোই আসবেন না নীলসাগরে। সরকারের যেন খেয়ালই নেই নীলসাগরের প্রতি।

মায়ের সঙ্গে বায়না ধরে প্রথমবারের মতো বেড়াতে এসেছে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার সামির (১৩)। কিন্তু এখানে এসে পানি আর গাছ ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি তার। নেই খেলার কোনো উপকরণ। মা শাহিদা বেগম জানান, আসলে সময় কাটানো এবং বিনোদনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে গড়ে তোলা যায় নীলসাগরকে। বর্তমানে এর যা অবস্থা, তাতে মানুষ বিরক্ত হয়ে ফিরে যাবে। দর্শনার্থী হালিম (২২), রেজাউল (২৩) জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নীলসাগর তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। দিনাজপুরের বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা স্বপ্নপুরী অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ নীলসাগরে অনেক কিছু থেকেও যেন কিছু নেই।

এলাকাবাসী বিশ্বাস করেন, নীলসাগর অপার সম্ভাবনাময় এক বিনোদন কেন্দ্র। সবার আগে প্রয়োজন এর আধুনিকায়ন। যদি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা যা করণীয় সব করা হয় তাহলে বদলে যাবে নীলসাগরের চিত্র। সেইসঙ্গে বদলে যাবে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার বাসিন্দার জীবনযাত্রার মান। দেশের সম্ভাব্য পর্যটন কেন্দ্রের তালিকায় ১৯ নম্বরে রয়েছে নীলসাগরের নাম। স্থানীয়দের দাবি, দিঘি খনন করে আধুনিক সৌন্দর্যবর্ধক উপকরণ দিয়ে জায়গাটিকে সাজিয়ে নীলসাগরকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হোক। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এখানে শিশু পার্ক জরুরি। চিড়িয়াখানা আছে, কিন্তু সেখানে কোনো প্রাণি নেই। এ দিকেও কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত। নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘দ্রুত নীলসাগরের আধুনিকায়নের কাজ করা হবে। নানা সমস্যার পরও নীলসাগর এখনও জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। দর্শনার্থী বাড়লে এখানকার সমস্যাগুলো সমাধান হবে অনেকাংশে।’

নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা মৌজায় ৫৩.৯০ একর জমির ওপর নীলসাগরের অবস্থান। নীলফামারী জেলা শহরের জিরো পয়েন্ট চৌরঙ্গী মোড় থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। রাজধানী থেকে বাস বা ট্রেনযোগে নীলফামারী শহরে এসে স্থানীয় পরিবহনে নীলসাগরে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে নীলফামারীর ভাড়া ট্রেন এসি ৪৪০ টাকা, নন-এসি ২২০ টাকা। বাস এসি ৭৫০ টাকা এবং নন-এসি ৬০০ টাকা।

লেখকঃ ইয়াছিন মোহাম্মদ সিথুন, সৌজন্যেঃ রাইজিংবিডি