Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

সুন্দরবনের ৮৫ কি.মি. জুড়ে তেলের স্তর

sundarbon

সুন্দরবনের ভেতরে শ্যালা নদীতে তেলের ট্যাংকার ডুবে যাবার পর নদীটির অন্তত ৮৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পানিতে এবং দু`পারে তেলের স্তর ভাসতে দেখা যাচ্ছে।

chardike-ad

মঙ্গলবার ভোর ট্যাংকারটি ডুবে যাবার ৪৮ ঘন্টারও বেশি সময় পার হবার পর এখন নদীটিতে দূষণের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকায় মঙ্গলবার ভোরে এমভি টোটাল ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় তলা ফেটে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার ফার্নেস তেল নিয়ে ডুবে যায় ট্যাংকার এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন। এই তেল ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব সুন্দরবনের নদ-নদী-খাল ও বন অভ্যন্তরে। দিনে দু’বার করে জোয়ারে তেলের আস্তরন ঢুকে পড়ছে সুন্দরবনের মাইলের পর মাইল ধরে বন অভ্যন্তরে। সুন্দরবনের শুধু বনজ সম্পদই নয়, ছড়িয়ে পড়া এ তেলের কারণে বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও কাকড়াসহ বিভিন্ন জলজ প্রানী হুমকির মখে পড়েছে। গত দু’দিনেও উদ্ধার করা যায়নি নিমজ্জিত তেলবোঝাই ট্যাংকারটি। অয়েল সুইপার জলযান দিয়ে ছড়িয়ে পড়া তেল তুলে নেওয়ার কোন ব্যবস্থা না থাকায় ম্যানগ্রোভ এ বনের গাছের শ্বাসমূল ঢেকে যাচ্ছে।

ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে সুন্দরবন বিভাগের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সরেজমিনে কাজ শুরু করেছে। তেল ট্যাংকার ডুবিতে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও জীব-বৈচিত্রের ১০০ কোটি টাকার উপরে ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মংলা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। দুই দিনেও খুজে পাওয়া যায়নি, ডুবে যাওয়া তেল ট্যাংকারের মাস্টার মোকলেসুর রহমানের (৫০) লাশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ল-ভ- হয়ে যাওয়ার পরও প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়ায় সুন্দরবন। এবারই প্রথম প্রকৃত অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।

জোয়ার-ভাটায় ছড়াচ্ছে তেল

দিনে দুইবার জোয়ার-ভাটার কারণে সুন্দরবনের নদ-নদী ও শাখা-প্রশাখাগুলোতে হু-হু করে ঢুকে পড়ছে এই তেলের বিস্তৃতি। যার ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সুন্দরবনের গাছপালা ও শ্বাসমূলে এই তেলের আস্তরণ পড়ছে। এ ছাড়া বিস্তৃত জায়গায় পশু-পাখি ও প্রাণিকুলও পড়ছে হুমকির মুখে।

বনবিভাগ সূত্র দাবি করেছে এ পর্যন্ত প্রায় সুন্দরবনের নন্দবালা থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার ডলফিনের অভয়াশ্রমসহ প্রায় ৮৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে আরো বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

সুন্দরবনের সম্পদ

সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশ অংশে স্থলভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার। আর ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। মানুষের কারণে সুন্দরবনের আয়তন আজ এখানে এসে ঠেকেছে। এ বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, এ উদ্ভিদকুলের ৭৩ ভাগই হচ্ছে সুন্দরী গাছ, ১৬ ভাগ গেওয়া, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড, রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভয়চর, ৩শ প্রজাতির পাখি। বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, ২১০ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সম্পদের হিসাব করা কঠিন। এ বনে দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণ ১৫৮ কোটি ৯ হাজার ৮০৭ পয়েন্ট ৮০ বিলিয়ন টাকা। এসব কারণে পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন হচ্ছে প্রকৃতির অপর বিস্ময়।

জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করে। সুন্দরবনের এ সম্পদের সবটাই এখন সংকটের মধ্যে পড়েছে। বিষেশজ্ঞদের প্রাথমিক হিসাব মতে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নন্দপাড়া নদী থেকে শ্যালা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদী পর্যন্ত মাছ ও জলজ প্রাণিসহ ডলফিনের অভয়াশ্রম এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে।

দুটি তদন্ত কমিটি গঠন

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকায় মঙ্গলবার ভোরে ফারনিস অয়েল বোঝাই ট্যাংকারডুবির পর এ বনের ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপণে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তা বেল্লাল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত এ তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ ও ঢাংমারী স্টেশন কর্মকর্তা প্রবল চন্দ্র রায়।

বুধবার সকাল থেকে এই তদন্ত কমিটি সরেজমিনে তদন্ত শুরু করেছে। এই কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যেই ডিএফও বরাবর তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। অন্যদিকে নৌ পরিবহণ মন্ত্রনালয় এই তেলবোঝাই ট্যাংকারডুবির ঘটনায় বুধবার তিন সদস্যের আলাদা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্স মিনার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে গঠিত এ কমিটির সদস্যরা হলেন সমুদ্র পরিবহণ অধিদপ্তর খুলনার অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শক আবু জাফর ও একই দপ্তরের বিশষ কর্মকর্তা নৌ-নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মহিউদ্দিন। এই কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে দুর্ঘটনার কারণ ও ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

ছড়িয়ে পড়া তেল রোধে ব্যারিকেড

তেল যাতে আরো বেশি ছড়িয়ে পড়তে না পারে সে জন্য নৌবাহিনী ও পদ্মা অয়েল কোম্পানি বুধবার দুপুরে ভাসমান তেল ও ডুবে যাওয়া জাহাজের চারপাশে মোটা পলিথিনের ব্যারিকেড দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। অপরদিকে, কাণ্ডারি-১০ জাহাজটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভাসমান তেলের ওপরে এক ধরনের পাউডার ছিটিয়ে তেল অপসারণের কাজ আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু করবে। সুন্দরবনের পানি ও পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।

উদ্ধারকারী জাহাজ

তেল অপসারণ ও উদ্ধার কাজে অংশ নিতে ঘটনাস্থলে যাচ্ছে নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস আখতারউদ্দিন ও ১০ সদস্যের ড্রাইভিং টিমসহ বিএনএস শাহ পরাণ। চট্রগ্রামের বিএনএস ঈশা খাঁ নৌঘাঁটি থেকে সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে জাহাজ দুটি। নৌবাহিনীর ১০ সদস্যের দলটি ডুবন্ত জাহাজ থেকে তেল অপসারণের কাজে অংশ নেবে।

নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও নির্ভীক। বিআইডাব্লিটিএর এই দুটি উদ্ধার যান বুধবার বিকেল পর্যন্ত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি। নৌপরিবহণমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভাসমান তেল নষ্ট করতে চট্রগ্রাম বন্দর থেকে রওনা দিয়েছে জাহাজ কাণ্ডারি-১০। এ জাহাজটি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভাসমান তেলের ওপরে এক ধরনের পাউডার ছিটিয়ে তেল নষ্ট করবে বলে জানিয়েছেন নৌমন্ত্রী।

অয়েল সুইপার জলযান

সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এ বন আমাদের গবর্, বিশ্ববাসীর গর্ব। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুন্দরবনের বুক চিরে পশুর চ্যানেল দিয়ে প্রতিদিন দেশি-বিদেশি জাহাজ মংলা বন্দরে আসে। তবে সুন্দরবনকে রক্ষায় নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। এ দুর্ঘটনার পর জানা গেল, বাংলাদেশে নেই কোনো অয়েল সুইপার জলযান। সুন্দরবন বিষেশজ্ঞ ও পরিবেশবিদ ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, এক-দুই দিনের মধ্যে অয়েল সুইপার জলযান এনে সুন্দরবনের নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়া ও গাছের শ্বাষমূলে লেগে থাকা তেল অপসারণ করতে হবে। তা না হলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে সুন্দরবন। তিনি আরো জানান, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের খেয়ালিপনার কারণে সুন্দরবন ধ্বংস হতে পারে না। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে অবৈধ এই নৌ চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ বনকে বাঁচাতে সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুন্দরবন বিভাগের মামলা

ট্যাংকার ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যের ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে, এ আশংকার কথা উল্লেখ করে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের স্টেশন অফিসার আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে মংলা থানায় একটি মামলা করেছেন। বুধবার দুপুরে মংলা থানায় দায়েরকৃত এ মামলায় ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার ফারনেস তেলবোঝাই ট্যাংকার ‘এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ মালিকের নামে মামলা করা হয়েছে। মংলা থানা সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে ট্যাংকার কর্তৃপক্ষ মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে বুধবার দুপুরে এমভি টোটাল ট্যাংকারের বিরুদ্ধে মংলা থানায় মামলা করেছে।

মন্ত্রীর ক্ষোভ

সুন্দরবনে ট্যাংকারডুবির খবর পেয়ে হেলিকপ্টার যোগে বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলে যান বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব।

তার সঙ্গে ছিলেন বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খন্দকার রাকিবুল ইসলাম, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী, সিএফ খুলনা কার্তিক চন্দ্র সরকার, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মু. শুকুর আলী ও পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের ডিএফও মো. আমির হোসাইন চৌধুরী। উপমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহাজ চলাচল অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান।