Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এক অন্তহীন ভালোবাসার সত্যিকার গল্প

46277_thumbm_31

‘টাইটানিকের’ রোজ এবং জ্যাকের ভালোবাসার মতোই গভীরতা তাদের ভালোবাসায়। তারা চেয়েছিলেন সহমরণ। হয়েছেও তা-ই। ৬৪ বছরের বিবাহিত জীবনে একটিবারের জন্যও স্বামী ট্রেন্ট উইনস্টেডকে (৮৮) দূরে ঠেলে দেননি ডলোরেস উইনস্টেড। তা-ই বুঝি বিধাতা তাদেরকে সহমরণ দিয়ে মনোবাসনা পূরণ করেছেন। ট্রেন্ট উইনস্টেডের কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কয়েক দিন ধরে তিনি কিছু খাননি। তার রক্তচাপ দ্রুত পড়ে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে তার অবস্থার অবনতি হয়। ডলোরেস বুঝতে পারেন ট্রেন্টকে আর হয়তো ফেরানো সম্ভব হবে না। তাই তিনি তাকে সুস্থ করে তোলার সব রকম চেষ্টাই করলেন। হাসপাতালে স্বামীর বিছানার পাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। দু’হাতে তার দুটি হাত আঁকড়ে ধরেছেন ট্রেন্ট। এভাবে কতটা সময় কেটে গেছে কিছুই বলতে পারেন না ডলোরেস। ফলে আস্তে আস্তে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শয্যাশায়ী হয়ে বিছানা হয় মৃত্যুপথ যাত্রী তার স্বামীর পাশে।

chardike-ad

যুক্তরাষ্ট্রের নাশভিলের এই দম্পতির কাহিনী উঠে এসেছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে। এতে বলা হয়েছে, ট্রেন্ট উইনস্টেড কোরিয়া যুদ্ধ করেছেন। তার রয়েছে দুটি সন্তান। তিনটি নাতি-নাতনী। আছে আটটি প্রো-পৌত্র। পেরিয়ে এসেছেন ৬ দশকেরও বেশি দাম্পত্য জীবন। এ সময়ে একজনের পাশ থেকে আরেক জন আলাদা হননি।

গল্পটা শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে। তখন ট্রেন্ট কোরিয়া যুদ্ধে যোগ দেবেন এমন সময় ডলোরেসের সঙ্গে তার প্রেম জমে ওঠে। ট্রেন্ট চলে যান যুদ্ধে। সেখান থেকে দীর্ঘ চিঠি লেখা শুরু করেন ডলোরেসকে। তাতে উঠে আসে নানা প্রেমের ব্যঞ্জনা। শেষ পর্যন্ত তিনি ডলোরেসকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। তাতে রাজি হয়ে যান ডলোরেস। তিনি ছিলেন একজন রক্ষণশীল নারী। তিনি রান্না করতে পছন্দ করতেন। অন্যদিকে ট্রেন্ট ছিলেন উদার মনের। তিনি মাঝে মাঝেই গলফ খেলতে বেরিয়ে পড়তেন। কখনো বা মাছ ধরতে ছুটে যেতেন। একপর্যায়ে ট্রেন্ট অবসরে যান। এ সময়ে তারা একত্রে সময় কাটানোর লম্বা এক সুযোগ পেয়ে যান। আদর করে তিনি ডলোরেসকে ডাকতেন ‘মাম্মা’ অথবা আইলিন নামে। তিনি জানতেন এ নামে ডাকলে ডলোরেসের কাছ থেকে চুমু উপহার পাবেন। তখন তিনি কল্পনার চোখে দেখতে পান বিয়ের অনুষ্ঠানে স্ত্রীর হাত ধরে নাচছেন তিনি।

তাদের মেয়ে শেরিল উইনস্টেড বলেছেন, তারা দুজন একে অন্যকে এতটাই ভালোবাসতেন যে শেষ দিনটি পর্যন্ত তা টিকে ছিল। একদিনের চেয়ে তার পরের দিন যেন তাদের ভালোবাসা আরও জোরালো হয়ে উঠতো। একপর্যায়ে ট্রেন্টের বমি বমি ভালো শুরু হয়। তিনি কিছু খেতে পারেন না। এ মাসের শুরুতে তার মেয়ে তাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। ৬ই ডিসেম্বর জরুরি বিভাগ থেকে তার পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায় তার কিডনি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে বাঁচাতে হলে ডায়ালাইসিস করাতে হবে। ফলে ট্রেন্টকে ভর্তি করানো হয় নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে। ডায়ালাইসিস শুরু হয়। এতে তার হৃদপি- আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থায় ডলোরেসের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেননি তাদের দু’সন্তান। ডলোরেস সহ্য করতে পারবেন এতটুকুই তারা তাকে জানাতে থাকেন। কিন্তু একপর্যায়ে তিনি জেনে যান ট্রেন্টের অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। তখন ডলোরেস সুস্থ। তিনি স্বামীর সেবা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ৭ই ডিসেম্বর প্রচ- মাথাব্যথার কথা জানান তিনি। এদিন রাত ১০টার দিকে তিনি হাসপাতালে তার স্বামীর রুমের ভেতর একটি চেয়ারে বসে আছেন বিশ্রাম নেয়ার ভঙ্গিতে। দেখে মনে হবে ক্লান্ত হয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন। ফলে তাকে দেখে কারো সন্দেহ হয়নি যে, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। এক সময় মেয়ে শেরিল তাকে জাগানোর চেষ্টা করলেন। কাঁধ ধরে ঝাঁকালেন। কিন্তু ডলোরেস কোনো সাড়া দিলেন না। তবে তিনি তখনও শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। নার্সরা ছুটে আসেন। দ্রুত তাকে নেয়া হয় জরুরি বিভাগে। দেখা যায় তার ব্রেন সক্রিয়তা শক্তি হারিয়েছে। তার মাথায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। হাসপাতালের স্টাফরা প্রথমে তাকে অন্য একটি রুমে নিয়ে রাখলেন। ভেন্টিলেটর যুক্ত করা হয়। সন্তানরা মায়ের এ অবস্থার খবর জানালেন তাদের পিতা ট্রেন্টকে। প্রথমে তিনি বুঝতে পারলেন না। এমনকি ডলোরেসের অবস্থা দেখে কার্ডিওলজিস্টরা পর্যন্ত কান্নাজুড়ে দিলেন। কারণ, এর আগের দিনও তারা ডলোরেসের সঙ্গে গল্প করেছেন। এ পর্যায়ে একজন পুরুষ নার্স ট্রেন্টকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে যান তার কাছে। স্ত্রীকে এ অবস্থায় দেখে ট্রেন্ট কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার বিছানার পাশে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন। স্ত্রীকে ডাকলেন ‘জেগে ওঠো আইলিন! হে ঈশ্বর তাকে জাগিয়ে দাও’। হৃদয়বিদারক এমন দৃশ্য দেখে নার্স, পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত কান্নায় ভেঙে পড়েন।  একদৃষ্টে স্ত্রীর বিধ্বস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন ট্রেন্ট। ডায়ালাইসিসের কারণে তার নিজের হৃৎপিন্ড ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ফলে তার মেয়ে তাকে মায়ের পাশে অবস্থান করতে অনুরোধ করেন। দু’জনকে দু’জনের হাত ধরিয়ে দেন। তিনি পিতা ট্রেন্টকে বলেন, বাবা আমি তোমার দেখাশোনা করবো। তুমি বেঁচে থাকো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলেন না ট্রেন্ট। দিন গিয়ে রাত এলো। ট্রেন্টের ঘুম আসে না চোখে। তিনি একটু পর পর জেগে যান। মেয়েকে ডাকেনÑ দেখো তো মাম্মা এখনও শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন কিনা?
মেয়ে তার মাকে পরীক্ষা করে বলেন, হ্যাঁ বাবা। তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। এই দম্পতির ক্রমাগত অবস্থার অবনতি দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি দম্পতিকে এমন অবস্থায় এক কক্ষে অবস্থান করার অনুমতি দেয়। তাদের বিছানা পাশাপাশি লাগিয়ে দেয়া হয়। আরও একটি দিন কেটে যায়। রাতে পাশাপাশি শুয়ে আছেন তারা। হাতে হাত ধরা।  ৯ই ডিসেম্বর রাত ৯টা ১০ মিনিট।

এ দম্পতির ৬৪তম বিবাহবার্ষিকীর মাত্র ৫ সপ্তাহ বাকি। এ সময় হাতে হাত ধরা অবস্থায় ডলোরেস নিস্তব্ধ হয়ে যান চিরকালের জন্য। তখনও ট্রেন্ট তার হাতে মৃত ডলোরেসের হাতের ঠা-া অনুভূতি পান নি। এভাবেই কেটে যায় কয়েক মিনিট। মেয়ে শেরিল উইনস্টেড ও ছেলে ইডি উইনস্টেড তখন শোক সাগরে ভাসছেন। পিতাকে এ খবরটি জাননোর সাহস পাচ্ছেন না। বলতে পারছেন না যে, তার বেস্ট ফ্রেন্ড ও সঙ্গিনী আর নেই। কিন্তু এ কথা তো গোপন রাখার মতো নয়। তাই শেষ পর্যন্ত পিতা ট্রেন্টের কাছে গেলেন ছেলে ইডি উইনস্টেড।

কম্পিত গলায় বললেন, মা আর নেই বাবা!
এ কথা শুনে যেন ভাষা হারিয়ে ফেললেন ট্রেন্ট। তিনি তার হাত উঁচু করলেন, যেন পাশেই শুয়ে থাকা স্ত্রীর প্রতি উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দিচ্ছেন। তারপর মেয়েকে বললেন, ওকে গোলাপি রঙের শবাধারে রেখো। পরিয়ো গোলাপি পোশাক। কারণ, এটাই ছিল ওর বাসনা। কী এক নির্মম পরিহাস! কয়েক ঘণ্টা পরেই মারা যান ট্রেন্টও।

মেয়ে শেরিল বলেন, বাবা মারা যাবেন এটা আমরা আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু মা মারা যাওয়ার এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মারা যাবেন এটা ভাবতে পারিনি। মা মারা যাওয়ায় তার হয়তো হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। তিনি সহ্য করতে পারেননি।

এই দম্পতির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয় ১৬ই ডিসেম্বর। এদিন শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠানে হিলারি স্কটের গাওয়া ‘লাভ রিমেইনস’ গানটি বাজানোর সিদ্ধান্ত নেয় পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্য দিয়ে বেঁচে রইল তাদের ভালবাসা। মানবজমিন।