Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

এক বাংলাদেশি চিকিৎসকের আরব জয়ের কথা

prodip
ডা. প্রদীপ চন্দ্র কর

১৯৮৪ সালে সৌদি আরবে চাকুরী নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পোস্টিং হলো আল-বাহা প্রদেশের স্বাস্থ্য বিভাগে। বাংলাদেশ থেকে ২৮৫ জন চিকিৎসক আমরা সেবার সৌদি আরবে নিয়োগ পেয়েছিলাম, আমরা ১৫জন আল-বাহাতে পোস্টিং পেলাম। ১/১০/১৯৮৪ একটি সৌদি বিমানে আমরা ১২ জন গেলাম, গিয়ে দেখি বাকী ৩জন ২/৩ দিন আগেই আল-বাহাতে পৌঁছেছেন, আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে তখন মাঝরাত, প্রচন্ড শীত, আমাদের থাকতে দিলো ওদের প্যরামেডিক ইনস্টিটিউটের ডরমিটরিতে, ৩ তারকা হোটেলের মতো থাকা খাওয়া। প্রতিদিন ডিজি অফিসে যাই, সারাদিন কাটাই, আবার ডরমিটরিতে ফিরে আসি। অবশ্য এরই মাঝে একে অন্যের সাথে পরিচিত হই, কমদামে আঙুর কিনে খাই, দু’একদিনের মধ্যেই স্থানীয় বাঙালিরা (তখন অবশ্য আল-বাহাতে হাতেগোণা সামান্য ক’জন বাঙালিই ছিলো) টের পেয়ে যান যে এখানে এতগুলো বাঙালি চিকিৎসক এসেছে একসাথে। তারা আসেন, তখন আর আঙুর কিনতেও হয় না।

তখনই দেখলাম, একসাথেই এসেছি, আমার এক ব্যাচ সিনিয়র, সলিমুল্লাহতে মেডিসিন এর রেজিস্ট্রার ছিলেন, আমাদের আগে যে তিনজন এসেছেন তাদের একজন ডা নীলাঞ্জন সেন এর বন্ধু তিনি, দুজনেই এফসিপিএস মেডিসিন পার্ট ওয়ান পাস, দু’বন্ধুই এত পড়ুয়া, দেশে থাকতেই জানতাম- দু’জনকে Running Davidson বলা হয়। আমরা পোস্টিং এর আগে ৮/১০ দিন বোধ হয় ছিলাম একসাথে, তখনই ধরা পড়লো আমার জ্যেষ্ঠ সেই চিকিৎসকটি অসুস্থ বোধ করছেন, খেতে পারছেন না, বমি বমি করছেন, সবাই ভাবলো- দেশ ছেড়ে এসেছেন তাই মন খারাপ, অনেকে ভাবলো হয়তো হঠাৎ অতিরিক্ত আঙুর খাওয়ার ফল। যাই হোক সবাই পোস্টিং নিয়ে চলে গেলাম, সেই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক আল-বাহার পাশেই ‘ওরাখ’ কেন্দ্রে, আমি চলে গেলাম অনেক দূর, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নাম ‘নাওয়ান’। গিয়ে সপ্তাহখানেক পরেই খবর পেলাম উনার হেপাটাইটিস ধরা পড়েছে। এই ছিলো শুরু।

chardike-ad

তারপর অনেকদিন গেছে। নানাভাবে মানিয়ে নেওয়ার এক অকল্পনীয় যুদ্ধ। আমাদের প্রথম Contract টি ছিলো ৩ বছরের। তিন বছর পর নীলাঞ্জন দা আর Contract রিনিউ করলেন না, চলে গেলেন বাংলাদেশে, ইচ্ছে এফসিপিএস পার্ট-২ করবেন, তার ‘ওরাখ’ এর বন্ধুটি, আমাদের সেই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক অনেক বুঝালেন তাকে, এফসিপিএস এ ফিরে না গিয়ে চল এমআরসিপি করি। নীলাঞ্জন দার পোস্টিং এর জায়গাটা দুর্গম ছিলো, আত্মবিশ্বাসও হয়তো ছিলো প্রবল। সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ৩ বছর পর তিনি ফিরেই গেলেন। তার সিদ্ধান্ত তার সাথে প্রবঞ্চনা করলো, যতটুকু জানি তার আর এফসিপিএস হয়নি।

এদিকে ‘ওরাখ’-এ কর্মরত আমাদের সেই চিকিৎসক বন্ধুটি এমআরসিপি পার্ট-১ পাশ করলেন। লন্ডনে একটি হাসপাতালে তাঁর locum চাকুরীর ব্যবস্থা ও হলো। ১৯৯০ বা ৯১ হবে, তিনি সৌদি আরবের চাকুরী থেকে পদত্যাগ করলেন, আমরা তাঁকে আল-বাহা’র পাশের একটি শহর নাম ‘বেলজুরাশি’, সেখানে একটি মনোরম প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে ভোজন আয়োজনের মাধ্যমে বিদায় জানালাম।

গল্পটি এখানেই শেষ হতে পারতো। অবশ্য সেক্ষেত্রে আপনারা আমাকে নিশ্চিতই কটু-কাটব্য করতেন, রেগেমেগে unfriend করে দিলেও অবাক হবার কিছু থাকতো না। কারণ শুধু এটুকু বলার জন্য কলম চালনা করা সুস্থ মনের পরিচায়ক হতো না মোটেও।

গল্পের এ অংশটা বলার জন্যই আগের ভূমিকাটুকু দিয়েছি।
আমাদের সেই কৃতি জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকটি বিলেত চলে যাওয়ার ৪/৫ বছর পরের ঘটনা। আপনাদের তো সেই ‘ওরাখ’ স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, সেই যে যেখানে আমাাদের সেই কৃতি চিকিৎসক বন্ধুটি কাজ করতেন। আমি ততদিনে ‘ওরাখে’র পাশের কেন্দ্র ‘বনি সার’এ বদলি হয়ে এসেছি। ‘বনি সার’টি ছিলো ‘আল বাহা’ প্রদেশের রাজধানী ‘আল বাহা সিটি’র একদম লাগোয়া। এটি ছিলো একটি বড় কেন্দ্র। চিকিৎসকের সংখ্যাও ছিলো বেশি। কারণটি হচ্ছে, আশেপাশের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রের চিকিৎসক ছুটিতে গেলে ‘বনি সার’ থেকে চিকিৎসক পাঠিয়ে বদলি ডিউটি ম্যানেজ করতে হতো।

যাহোক, তেমনি এক বদলি ডিউটিতে আমাকে একবার ‘ওরাখ’ যেতে হয়েছিলো। একদিন ডিউটি করছি হঠাৎ শুনি বাইরে থেকে একজন সৌদি বৃদ্ধা ‘ওয়েন ডকতর মোহাম্মদ, ওয়েন ডকতর মোহাম্মদ’- কোথায় ডা. মোহাম্মদ, কোথায় ডা. মোহাম্মদ? বলে আমার রুমে ঢুকছেন। দারোয়ান যতই বোঝায়- এই ডাক্তার তার ঈপ্সিত চিকিৎসক মোহাম্মদ নন, বৃদ্ধাও ততই নাছোড়-বান্দা। তিনি শুনে এসেছেন বাংলাদেশি ডাক্তার এখানে কাজ করছে আজ, ভেবেছেন বাংলাদেশি ডাক্তার যেহেতু সেহেতু ডাক্তার মোহাম্মদই হবেন, এরূপ বিশ্বাস থেকেই বৃদ্ধা সবাইকে ছাড়িয়ে একেবারে আমার সামনে এসে হাজির। এখানে একটা কথা বলে রাখি, সৌদি নামকরণের প্রথা অনুসারে নামের প্রথম অংশটি হচ্ছে ব্যক্তির নিজের নাম। আমাদের বেশির ভাগ মানুষের নাম তো শুরু হয় মোহাম্মদ শব্দটি দিয়ে, ওরা ভাবে এটিই ওই ব্যক্তিটির নাম। এভাবেই ওদেশে প্রায় সবারই নাম হয়ে যায় মোহাম্মদ। যাহোক, আমি স্পষ্টই বুঝতে পারলাম আমার সামনে এসে বৃদ্ধা হতাশ হলেন, তিনি যাকে খুঁজছেন আমি সে নই। আমি তাকে বসালাম, জানতে চাইলাম তিনি কাকে কি জন্য খুঁজছেন। তিনি যা বল্লেন, তার মর্মার্থ হচ্ছে, তিনি আমাদের সেই কীর্তিমান চিকিৎসকটিকেই খুঁজছেন যিনি বহু আগেই লন্ডন চলে গেছেন এবং শুধু একটু কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যই খুঁজছেন তাঁকে।

বিষয়টি হচ্ছে, এই বৃদ্ধা দীর্ঘ দিন যাবত কানে শুনতেন না। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। আগে মিশরীয় এবং পাকিস্তানি ডাক্তাররা দেখেছে। আমরা যাবার আগে সৌদি আরবে মূলত ফিলিস্তিনি, মিশরীয় আর পাকিস্তানি ডাক্তাররা রাজত্ব করেছে। কোনো ডাক্তারই তাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেনি। একের পর এক ড্রপ (সৌদি আরবের সরকারী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ফার্মেসী, ওষুধের তো আর অভাব নেই) দিয়েছে, ভিটামিন দিয়েছে, নানা জাতের এন্টিবায়োটিক খাইয়েছে, রোগ ক্রমাগত বেড়েই গেছে। ৮/১০ বছর তিনি এভাবে ভুগেছেন। এইসময় সেই বাঙালি চিকিৎসকটি তাদের কেন্দ্রে এসেছেন, বৃদ্ধা তাঁকে দেখিয়েছেন। সেই ডাক্তার তাকে যত্ন করে দেখেছেন, বৃদ্ধা বলছেন- মনে হলো এই প্রথম একজন প্রকৃত চিকিৎসক তাকে দেখলো। সেই চিকিৎসক দেখলেন রোগটি অতি সামান্য, বৃদ্ধার দুটো কানই দীর্ঘদিন থেকে ময়লা জমে জমে শক্ত হয়ে কানের বাইরের নলাকার অংশটি পুরোপুরি শব্দ তরঙ্গ বয়ে নিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। অশিক্ষিত, ধুলোবালিতে সারাদিন পরিশ্রমকারী, তাঁবুনিবাসী এই দরিদ্রা নারীটি নিজে নিজের যত্ন নিতে পারেন নি, যারা সেবা দেবেন বলে বেতনভোগী ছিলো তারা এই মানুষটির সাথে প্রতারণা করেছে। এই প্রথম একজন তাকে ভালোভাবে দেখলেন, ধীরে-সুস্থে কয়েকদিন ধরে তার কান দুটো পরিস্কার করলেন।

এক অসহায় নারী, একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা অবাক হয়ে, আনন্দিত হয়ে, অশ্রুসজল হয়ে লক্ষ্য করলেন- তিনি শুনতে পাচ্ছেন! তিনি শুনতে পাচ্ছেন! তিনি সেই চিকিৎসকের মাথায়, কপালে চুমোর পর চুমো, চুৃমোর পর চুমো দিয়ে ভরিয়ে দিলেন। তিনি এখন তার গানাম (ভেড়া) এর ডাক শুনতে পাবেন, জামাল (উট) এর আওয়াজ বুঝতে পারবেন। আজান এর মধুর ধ্বনি এখন তার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারবে। তিনি আনন্দে কাঁদলেন। প্রাণ ভরে ডা. মোহাম্মদকে তিনি দোয়া করলেন।

কাহিনীটি বলতে বলতে তিনি আমার সামনে বসেই আবেগাপ্লুত হলেন। অনুরোধ করলেন, যদি কোনোদিন তার প্রিয় এই ডাক্তারটির সাথে দেখা হয়, আমি যেন তাঁকে বৃদ্ধার সালাম পৌঁছে দিই। আর যেন বলি, তিনি এখনো ভালো আছেন, তিনি এখনো শুনতে পাচ্ছেন।

একসময় বৃদ্ধা চলে গেলেন। কিন্তু আমাকে দীর্ঘক্ষণের জন্য অসার করে দিয়ে গেলেন। একজন চিকিৎসক হিসেবে গর্বিত বোধ করতে লাগলাম, একজন বাঙালি হিসেবে আমার বুকটা টান টান হয়ে উঠলো।

আজ সেই চিকিৎসক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। আমি জানি সেই বৃদ্ধাটির মতো অসংখ্য মানুষের কল্যাণ কামনায় আজ তিনি খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছেন।

আপনারা হয়তো এতক্ষণে সেই মহৎ প্রাণ মানুষটির নামটি জানার জন্য আগ্রহ বোধ করছেন। হ্যাঁ পাঠক, তিনি সেই মানুষটি যাকে এই মুহূর্তে আমরা অনর্থক নাস্তানাবুদ করছি। ভুল বুঝে ভুল আচরণ করছি। তিনি হচ্ছেন আমাদের দেশের চিকিৎসাঙ্গনের বরণীয় জন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।

পুন: লিখাটি স্যার এর দৃষ্টিগোচর হলে দুই যুগ আগে বৃদ্ধাটি যে অনুরোধটি করেছিলো তা দেরীতে হলেও পালিত হবে।

লেখকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে নেওয়া