Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

উদীয়মান দেশগুলোর উন্নয়নের মডেল মালয়েশিয়া

১৭ সেপ্টেম্বর, সিউল:

আজ প্রজাতন্ত্র দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে মালয়েশিয়া। গত ৫০ বছরে গুণগতভাবে ও আকারে অনেক বেড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির অর্থনীতি। বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা সংকট মোকাবেলায় তাদের সামর্থ্য বাড়ছে দিন দিন। বেড়েছে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। একটি কৃষিনির্ভর অর্থনীতিকে বাণিজ্য ও শিল্প সক্ষমতায় সত্যিই অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে মালয়েশিয়ার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যা তাদেরকে উদীয়মান দেশের মডেল হিসেবে তৈরি করেছে।

chardike-ad

চলতি মাসে প্রতিযোগী সক্ষমতার বিচারে মালয়েশিয়াকে বিশ্বের ১৪৮টি দেশের মধ্যে ২৪তম ঘোষণা করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। এদিক থেকে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অর্থনীতিগুলোর চেয়েও এগিয়ে দেশটি। এটি মালয়েশিয়ার হঠাৎ পাওয়া কোনো সাফল্য নয়। দেশটির অর্থনৈতিক আকার, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার সক্ষমতা ও শক্ত মৌলভিত্তি— এর মূল কারণ, যার পেছনে রয়েছে দেশটির বাস্তববাদী নেতৃত্বের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম।

KLCC
এ র‍্যাংকিং মালয়েশিয়ার করপোরেট খাতের জন্যও মাইলফলক। ষাটের দশক পর্যন্তও সামগ্রিকভাবে অবস্থা খুব ভালো ছিল না করপোরেশনগুলোর। কিন্তু এরপরই কৃষি ও প্রাথমিক শিল্পনির্ভর অর্থনীতিকে শিল্পোন্নত করতে নানামুখী উদ্যোগ নেয় সরকার।

তখন এসব পদক্ষেপ নিয়ে অনেকের মন দোদুল্যমান অবস্থানে থাকলেও এখন তা দূর হয়েছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যা এর পাঁচ দশক পরের অর্থনীতিকে দেখলেই বোঝা যায়। দেশী-বিদেশী অর্থনৈতিক চাপ মোকাবেলা, ২ কোটি ৭০ লাখের মতো মানুষের জীবন-জীবিকা, খাদ্যনিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তায় সাফল্যের পাল্লা প্রতিবেশী উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক ভারী।
জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন রিঙ্গিতে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে ৬ হাজার ৭০০ মার্কিন ডলার। আগামী বছরগুলোয় তা দ্বিগুণে উন্নীত হবে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা। এছাড়া দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশেরও কম মানুষ। শিক্ষার হার ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মহাসচিব মোহাম্মদ ইরওয়ান সেরিগার আবদুল্লাহ বলেন, ‘একটি কৃষিনির্ভর অর্থনীতি দ্রুতই শিল্পে এগিয়ে গেছে। এটি একটি সাফল্যের গল্প। আমরা দক্ষিণ কোরিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম। তবে আমাদের মূল লক্ষ্য এখন মাঝারি আকার থেকে উচ্চ আয়ের দেশ হয়ে ওঠা।’

এদিকে দ্রুতই রাবার ও আকরিক টিনের মতো কাঁচামাল বিক্রেতা মালয়েশিয়াকে একটি সমন্বিত ও আধুনিক অর্থনীতির দেশে রূপান্তর করেছে সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৪০টির মতো দেশের পাঁচ হাজারের বেশি কোম্পানি তাদের প্রধান উত্পাদন ও সেবাকেন্দ্র মালয়েশিয়ায় স্থাপন করেছে। জ্বালানি থেকে শুরু করে কম্পিউটার, ভোক্তা ইলেকট্রনিকস, পরামর্শক সেবা— সবই আছে এ তালিকায়। এর জন্য বিদেশী কোম্পানিগুলোকে যেসব সুবিধা দেয়া প্রয়োজন, তা দিয়েছে সরকার। কিন্তু উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের মতো বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বে জাতির লোকসানের অভিযোগও তেমন শোনা যায়নি তাদের বিরুদ্ধে। এ অর্জনের মূলে রয়েছে দূরদর্শীদের নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা। ব্যবসাবান্ধব নীতি তাদেরকে আসিয়ানের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার অর্থনীতিতে পরিণত করেছে।

এদিকে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ‘আরো ভালো করা’র এ আক্ষেপ ও তাগিদ সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোয় তাদের অর্জন রীতিমতো ঈর্ষণীয়। ১৯৬০ সালে চালু হয় তাদের শেয়ারবাজার বার্সা মালয়েশিয়া। তালিকাভুক্ত ৯ শতাধিক কোম্পানির মোট বাজার মূলধন ১৩০ কোটি রিঙ্গিতেরও বেশি, এশিয়ায় তৃতীয় বৃহত্তম। এ প্রসঙ্গে ইরওয়ান জানান, একটি বড় গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে দেশটির অর্থনীতিতে। মালয়েশিয়া একটি সরকারি ব্যবস্থাপনাভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেসরকারি খাতনির্ভর বাজারে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন মডেলটির প্রধান আকর্ষণই এখানে। তবে এখনো বাজার এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারি নীতি ও নানা উদ্যোগের কম-বেশি সমন্বয় ঘটিয়েই এগুচ্ছেন তারা।

তার মতে, রূপান্তরগুলো খুব সহজ ছিল না। কৃষি থেকে শিল্পে পদার্পণ কিংবা বেসরকারি খাতের ভূমিকা বাড়াতে মানুষের মানস কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে হয়েছে নেতৃত্বকে। রাবার ও টিন ব্যবসায়ে জড়িত অনেক কোম্পানিই গুটিয়ে যাচ্ছিল। রফতানি কমে যাচ্ছিল। এগুলো দক্ষভাবে সামলাতে হয়েছে নীতিনির্ধারকদের। দেশটির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তার বিশেষ দায়িত্ব পালন করা ইরওয়ান আরো বলেন, গবেষণা ও উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়া, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উত্সাহ দেয়া সবই করা হয়েছে। করপোরেট সাফল্য বৃদ্ধিতে বিদেশী বাজারের গুরুত্বও ছিল অনেক।

অনেক কৃষি খামার ও টিন খনির জায়গায় উচ্চপ্রযুক্তির কারখানা বসানো হয়েছে। তাইওয়ান, হংকং কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশীয় আইকনদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম কম্পিউটার ও ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার ও অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাত, পারমাণবিক ওষুধ প্রযুক্তি কিংবা উড়োজাহাজ নির্মাণ— সব শিল্পই গড়ে ওঠেছে দেশটিতে। বিদেশীদের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে অনেক স্থানীয় কোম্পানি। তারা উড়োজাহাজ কিংবা সাইকেল নির্মাণ থেকে শুরু করে টেলিকম বা ব্যাংকিং সেবার ব্যবসায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যৌথ কিংবা নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করছে। অনেক সুবিধাজনক দেশে তাদের কারখানাও স্থাপন করেছে মালয় করপোরেশনগুলো। ইরওয়ান বলেন, ‘আমাদের করপোরেশনগুলোকে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশের কাতারে যোগ দিতে চাই। মালয়েশিয়ার শতবর্ষেও আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ, দেশপ্রেমিক, উন্নত মালয়েশিয়া চাই।’

মালয়েশিয়ান রিজার্ভ, এপি অবলম্বনে মাহফুজ উল্লাহ বাবু (বণিকবার্তা থেকে নেওয়া)