Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

‘সাড়ে তিন মাস আলোর মুখ দেখি নাই, শুধু পিটায়’

saddam‘এক ঘরের মধ্যেই আমাকে সাড়ে তিন মাস আটকে রাখছিল, সাড়ে তিন মাসে এক দিনও আলোর মুখ দেখি নাই। সকালে টাকার জন্য একবার পিটায় আবার বিকেলে টাকার জন্য একবার পিটায়। তারা বলে, তোর বাড়িত থেকে তাড়াতাড়ি টাকা পাঠাতে বল। ভাইয়ের কাছে যা টাকা ছিলে সব দিয়ে দিছে, আমাদের কিছু জমি জায়গা ছিল তাও বেইচ্যা টাকা দিছে।’

এভাবেই বন্দিদশার বর্ণনা দিচ্ছিলেন মো. সাদ্দাম হোসেন (২৩)। ভালো চাকরির আশায় লিবিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ১১ মাস লিবিয়ায় বন্দি থাকার পর তাঁকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

chardike-ad

গত শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যালয়ে কথা হয় সাদ্দামের সঙ্গে। তিনিই জানালেন পুরো ঘটনা।

যেভাবে লিবিয়ায় গিয়ে অপহরণ: তসলিম উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাদ্দামের বড় ভাই মো. হিরণ তালুকদার তাঁকে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া পাঠান। লিবিয়া বিমানবিন্দরে নামার পরই আগে থেকে ঠিক করে রাখা দুই বাংলাদেশি ও তিন লিবীয় মিলে তাঁকে একটি গাড়িতে তোলেন। গাড়িতে ওঠার পর বেশ আনন্দ হচ্ছিল বলে জানালেন তিনি। কারণ তিনি একটি ভালো চাকরিতে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন।

একসময় গাড়িটি গিয়ে থামে একটি শহরে। পরে সাদ্দাম জানতে পারেন ওই শহরের নাম মদিনা। সেখানে একটি বাড়িতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে প্রবেশ করে তিনি দেখতে পান তার মতো আরো ১৪ জন বাঙালি সেখানে রয়েছেন। এরপর সাদ্দামকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন ওই ঘরে থাকা অন্য বাংলাদেশিরা তাকে বলেন, ‘কীভাবে তুমি এই ফাঁদে পা দিলে? এরা আমাদের মতো তোমাকেও অপহরণ করে নিয়ে এসেছে।’

প্রথমে এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না সাদ্দামের। কিন্তু বিকেলে একজন এসে সাদ্দামকে ডেকে নিয়ে বলে যে, ‘তোর বাড়ি থেকে আরো টাকা নিয়ে আয়’। কিন্তু সাদ্দাম বলেন, ‘চার লাখ টাকা নগদ দিয়ে তিনি এই দেশে এসেছেন চাকরির জন্য। তাহলে এখন কেন আরো টাকা লাগবে?’

এ কথা বলার পরই ওই বাংলদেশি আর দুই লিবিয়ান মিলে মারধর শুরু করে সাদ্দামকে। এই মারধরের দৃশ্য ভিডিও করে পাঠানো হয় সাদ্দামের বড় ভাই মো. হিরণ তালুকদারের কাছে।

ভাইকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে টাকা পাঠাতে শুরু করেন হিরণ। এভাবে সাড়ে তিন মাসে ৫০ হাজার, এক লাখ করে প্রায় তিন লাখ টাকা দেন তিনি। কারণ টাকা দিতে দেরি হলেই মারধর করা হতো সাদ্দামকে। তিন বেলা তো দূরের কথা দু-একদিন পরপর অল্প করে কিছু খেতে দেওয়া হতো তাঁকে।

মুক্তি না দিয়ে বিক্রি: সাড়ে তিন মাস অত্যাচার করে টাকা আদায়ের পর পাকিস্তানি একটি চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় সাদ্দামকে। সেই চক্রের সদস্যরা আবার সাদ্দামকে মারধর করে তার ভাইয়ের কাছে থেকে টাকা আদায় করে। তারা কিছু টাকা পাবার পরে সাদ্দামকে আবার অন্য একটি চক্রের কাছে বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে সাদ্দামের ভাষ্য মতে, তাকে তিন থেকে চারবার লিবিয়ায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।

এই চক্রের সদস্য কারা ছিল জানতে চাইলে সাদ্দাম বলেন, মূলত বাঙালি, লিবীয় ও পাকিস্তানিরাই ছিল। প্রতিটি চক্রে এরা দুই-তিনজন করে থাকত।

যেভাবে মুক্তি ও আসামি গ্রেপ্তার: সাদ্দামের বড় ভাই হিরণ তালুকদার বলেন, জমানো টাকা পয়সা জায়গা জমি সব কিছু বেঁচে দিয়ে ভাইকে বাঁচানোর জন্য তিনি লিবিয়ায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ টাকা পাঠিয়েছেন ১১ মাসে। কিন্তু তবুও যখন ভাইকে ফেরত পাচ্ছিলেন না, তখন সাদ্দামকে উদ্ধার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহায্য নেন তিনি। এ জন্য পিবিআই এবং লিবিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাঁদের দেওয়া তথ্যমতে, ওই চক্রের বাংলাদেশের চারজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পিবিআইয়ের সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিশেষ পুলিশ সুপার আহসান হাবিব পলাশ জানান, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন তসলিম উদ্দিন (৫০), মোফাজ্জেল হোসেন (৪৮), আইয়ুব আলী (৫২) ও আরমান সরকার (৪২)।

আহসান হাবিব পলাশ জানান, পিবিআই সদস্যরা একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা ও কিশোরগঞ্জ থেকে মানবপাচার চক্রের ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

এঁরা উচ্চ বেতনে বিদেশে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের লিবিয়ায় পাঠাতেন। লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর দেশটিতে অবস্থানকারী চক্রের অন্য সদস্যরা ওই ব্যক্তিকে আটকে রেখে মারধর করে তাঁর পরিবারের কাছে মুক্তিপণের টাকা আদায় করত। সূত্র: এনটিভি অনলাইন