Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়তে চাইলে যা করতে হবে

south-koreaপৃথিবীতে দক্ষিণ কোরিয়া একটি বিস্ময়কর রাষ্ট্র। নেই কোন তেল, খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ তরতর করে বিশ্বের বুকে নাম করে নিয়েছে। ষাটের দশকেও দক্ষ জনবল ও অর্থ সংকটে ভোগা দক্ষিণ কোরিয়া এখন বিশ্ব অর্থনীতির পরাশক্তির একটি। দিনকে দিন দেশটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিজেকে।

প্রায় ৯৯ হাজার বর্গ কিমি এর দক্ষিণ কোরিয়ার ৯টি প্রভিন্স-নর্থ ছুংছন, সাউথ ছুংছন, খাংউওন, খিয়ংগিদো, নর্থ খিয়ংসাং, সাউথ খিয়ংসাং, নর্থ জল্লা, সাউথ জল্লা এবং জেজু স্পেশাল এ বিভক্ত। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী এবং পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত নগরী সিউলকে বলা হয় স্পেশাল সিটি। সিউল ছাড়া মেট্রোপলিটন সিটি রয়েছে ৬টি । সেগুলো হলো- ইনছন, বুসান, দেগু, দেজন, খোয়াংজু, উলসান।

chardike-ad

১৬ ডিসেম্বর ইনছন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে বিস্মিত হই। অবাক দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম নিরাপদ সার্ভিসের দিক থেকে বিশ্বসেরা এই বিমানবন্দরটি। যা গড়ে তোলা হয়েছে রাজধানী থেকে প্রায় ৬০ কিমি দূরে ইনছন শহরে। বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়ার সভাপতি হাবিল উদ্দীন ভাইয়ের গাড়িতে করে রাজধানীর দিকে যেতে যেতে দেখলাম মহাসড়ক এবং আশপাশের শহর। যতো ভেতরের দিকে যাচ্ছি ততোই বিস্মিত হচ্ছি। আমরা বাংলাদেশ থেকে কোরিয়া সম্পর্কে যা শুনেছি তার চেয়েও শতগুণ বেশি উন্নত এই দেশ।

এখানকার সর্বত্রই উৎকৃষ্ট প্রযুক্তির ছোঁয়া। প্রত্যেকটি কাজ হয় অনলাইনে। মহাসড়ক থেকে শুরু করে ট্রেন, বিমান সবকিছু একটি কাঠামোবদ্ধ নিয়মে পরিচালিত।

বাংলাদেশি অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেলো, নিরাপদ সার্ভিস, উন্নত জীবনযাত্রা, বুদ্ধিদীপ্ত নাগরিক, নারী-পুরুষের সমতা, আইন-বিচার, নাগরিক সেবা, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা, সর্বোচ্চ গণতন্ত্রের চর্চা হয় কোরিয়ায়। দেশটির ট্রাফিক ব্যবস্থা অসাধারণ। গাড়ির কোন বিকট শব্দ নেই। মানুষগুলোও কথা বলেন ধীরে, যেন অন্যদের ডিস্টার্ব না হয়।

কারো কোন কিছু হারানোর সুযোগ নেই কোরিয়ায়। চুরি হওয়ারও সুযোগ নেই। চুরি করার কয়েক মিনিটের মধ্যে ধরে ফেলবে চোরকে। প্রত্যেকটি স্পটে উন্নত সিসি ক্যামেরা।

জানা গেলো, অপরাধ কর্ম সংঘটিত হওয়ার ২-৩ মিনিটের মধ্যে পুলিশ এসে পড়ে ঘটনাস্থলে। এখানে সবকিছুর আগে মানুষের নিরাপত্তা। মানুষ যে সবকিছুর ঊর্ধ্বে কোরিয়ায় এই আদর্শের চর্চা হয়।

দক্ষিণ কোরিয়া এক সময় গার্মেন্টস উৎপাদনে শীর্ষে ছিলো। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে বেরিয়ে এসে এখন তথ্য-প্রযুক্তি উৎপাদন এবং রপ্তানিতে শীর্ষ সারিতে অবস্থান করছে। বিশ্বখ্যাত স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই, দেউ এর মতো ব্রান্ডগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে দক্ষিণ কোরিয়া ২০১৩-১৪ সালে মোবাইল ফোন উৎপাদনে বিশ্বে প্রথম, কম্পিউটার চিপস ও জাহাজ তৈরিতে দ্বিতীয়, মোটরগাড়ি প্রস্তুতিতে পঞ্চম ও ইস্পাত শিল্পে ষষ্ঠ স্থানে।

একসময় জাপানের করায়ত্তে থাকা কোরিয়ায় ১৯৬২ সালেও দক্ষ জনবলের সংকটে ভুগত। এরপর থেকে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। কোরিয়ার এই অগ্রগতির পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো শিক্ষা এবং গবেষণায় গুরুত্ব প্রদান।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মনির কোরিয়ায় পিএইচডি করছেন। কোরিয়ার অগ্রগতি নিয়ে তার বক্তব্য ছিলো এক কথায়, ‘পরিশ্রম, ডেডিকেশন, সময়ের গুরুত্ব এবং শিক্ষা ও গবেষণায় সবচেয়ে গুরুত্বদানের জন্যই দক্ষিণ কোরিয়া আজ এতোটা অগ্রগতি লাভ করেছে!’

দক্ষিণ কোরিয়া তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজিয়েছে আমূল সাজে। বর্তমানে কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বখ্যাত। সেরা শিক্ষাব্যবস্থার র‌্যাংকিংয়ে সেরা পাঁচে দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান এখন নিয়মিত ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থাকে সবসময়।

সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কাইস্ট, কোরিয়া ইউনিভার্সিটি, ইয়নসে ইউনিভার্সিটি, খিয়ংহি ইউনিভার্সিটি, ইনহা ইউনিভার্সিটি এর মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে কোরিয়ায়।

south-korea-varsityকোরিয়ায় প্রায় ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান প্রায় সমান। একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যেতে নিত্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। রাজনীতি নয়, এখানে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবন এবং সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য।

এর মধ্যে সিউল ন্যাশনাল ইউনির্সিটি বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে ৩০ এর ভেতর। এটি কোরিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ার চতুর্থ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থীই আছে প্রায় ১০ হাজারের মতো। এর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা ২৬, ৬২০ জন।

দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি আছে ১৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থী। পিএইচডি গবেষকের সংখ্যা অনেক। কোরিয়ায় অধ্যয়ন (পিএইচডি এবং স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) করছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে কথা বলে জানা গেলো, দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষার মূল শক্তি হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়া। শিক্ষার মান আর গবেষণার বহুমুখিতাই কোরিয়াকে বিশ্বব্যাপী ছাত্রছাত্রীদের কাছে উচ্চশিক্ষার অন্যতম পছন্দ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আমরা দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার পর এই কদিনে অনেকে জানতে চেয়েছেন সেখানকার পড়ালেখা করার সুযোগ কেমন। তাই এবিষয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আমি সহযোগিতা নিয়েছি দক্ষিণ কোরিয়ায় অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মতামত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট, পূর্ববর্তী বিভিন্ন লেখার সোর্স এবং উইকিপিডিয়ার।

south-korea-educationদক্ষিণ কোরিয়ায় অধ্যয়ন করতে চাইলে…

স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করার জন্য বাংলাদেশিরা কোরিয়ায় যেতে পারেন। কোরিয়ান স্কুলগুলোতে ফল ও স্প্রিং এই দুই সেমিস্টারে বিদেশি শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন।

স্নাতকে অধ্যয়ন: দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম’ বা স্নাতকে ভর্তি বেশ প্রতিযোগিতামূলক। এসএসসি, এইচএসসি অথবা ও-লেভেল, এ-লেভেলে খুব ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি ‘সহশিক্ষামূলক’ কাজের যুক্ত থাকলে সুবিধা পাওয়া যায়। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য এসবের বিকল্প নেই। তাই এসএসসি থেকেই সহশিক্ষামূলক কাজ সেটা হতে পারে, বিতর্ক, খেলাধুলা, ছোটখাটো উদ্ভাবনী কর্ম, টুকটাক গবেষণা, মিউজিক, নৃত্য বা অন্য যে কোনো কিছু বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকা সহায়ক।

স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি: স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি করা যায় দু’ভাবে- কোরিয়ার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের গবেষণা সহকারী হিসেবে এবং কোরিয়ান সরকারের বৃত্তি (স্কলারশিপ) প্রোগ্রাম বা গ্লোবাল আইটি কোরিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপের আওতায়।

প্রথম ক্ষেত্রে পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করে নিজের গবেষণার আগ্রহ অনুযায়ী সরাসরি কোনো অধ্যাপকের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করা যায়। ই-মেইলে থাকতে পারে স্নাতকের সিজিপিএ, আইএলটিএস, টোফেল বা জিআইর স্কোর, পাবলিকেশন যদি থাকে, নির্দিষ্ট বিষয়ে গবেষণায় আগ্রহের কারণ এবং এই ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখে দিতে হবে।

অধ্যাপক নির্বাচনের আগে সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন করতে হবে। কোরিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির শর্ত ভিন্ন ভিন্ন। সাধারণত কোরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বনিম্ন সিজিপিএ ৩.০০ এবং আইএলটিএস স্কোর ৬.০০-কে নূন্যতম যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। ভালো র‌্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো সিজিপিএ এবং আইএলটিএস স্কোর চায়। সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পূর্বশর্তগুলো দেখে এবং নিজের অবস্থান যাচাই করে অধ্যাপককে ই-মেইল করা উত্তম।

অধ্যাপকের সম্মতি ছাড়া কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজস্ব কিছু বৃত্তির ব্যবস্থা আছে। তবে বৃত্তির সংখ্যা সীমিত। যেসব ছাত্রছাত্রী অগ্রাধিকার পান তাদেরকে গবেষণার সহকারী হিসেবে নিতে চান অধ্যাপকরা। গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য যে মাসিক বৃত্তি দেওয়া হয়, তা দিয়ে এখানকার অন্যান্য খরচ চলে যায়।

sentbe-adআবেদন প্রক্রিয়া: দক্ষিণ কোরিয়ান সরকারের স্কলারশিপ প্রোগ্রামে (কেজিএসপি) ‘গ্র্যাজুয়েট’ এবং আন্ডারগ্র্যাজুয়েট’ উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। নিজ দেশের কোরিয়ান দূতাবাস থেকে অথবা কোরিয়ায় এই প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থী হিসেবে সরাসরি আবেদন করা যায়।

গ্লোবাল আইটি কোরিয়ার গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রাম (জিআইকেজিএসপি) সাধারণত স্নাতকোত্তর লেভেলে বৃত্তি দিয়ে থাকে। এটিও কোরিয়ান সরকারের বৃত্তি। তবে সে জন্য অধ্যাপকের সুপারিশ থাকলে সুযোগ পাওয়া সহজ হয়ে যায়।

কেজিএসপি প্রোগ্রামে অধ্যয়ন করতে প্রথম একবছর কোরিয়ান ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। বিস্তারিত: http://bit.ly/1jfn7PL

আগেই উল্লেখ করেছি যে, কোরিয়ায় বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। যারা স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি গবেষণারত। কোরিয়ায় বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের সংগঠনও রয়েছে। বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের কেউ কোরিয়ায় অধ্যয়ন করতে চাইলে আবেদনের আগে #Bangladesh Students Community in Korea ঠিকানায় গিয়ে ওখানকার অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে তথ্য নিতে পারেন। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন এবং অধ্যাপক পাওয়ার ক্ষেত্রে সংগঠনটি সহযোগিতা করতে পারে। এছাড়া কোরিয়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন #Bangladesh Community in Korea (BCK) এর ফেসবুক গ্রুপে গিয়েও তথ্যের জন্য সহযোগিতা চাইতে পারেন।

এবিষয়ে বাংলাদেশে কমিউনিটির বর্তমান সভাপতি হাবিল উদ্দীন (যিনি ২৬ বছর ধরে কোরিয়া প্রবাসী) এবং সাধারণ সম্পাদক সরওয়ার কামাল (যিনি গুগল কোরিয়ায় কর্মরত এবং কোরিয়ায় বাঙালিদের মুখপাত্র ’বাংলা টেলিগ্রাফের সম্পাদক) যথেষ্ট সহযোগী মনোভাবাপন্ন এবং তারা বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।

তবে সব সহযোগিতার ঊর্ধ্বে উঠে নিজের সকল যোগ্যতা নিশ্চিত করেই দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়ালেখার জন্য আবেদন করতে হবে। সবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আমি কি তৈরি?

লিখেছেন: সাইফুল্লাহ সাদেক, সৌজন্যে: চ্যানেলআই অনলাইন