Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

গবেষণায় অনন্য অপ্রতিরোধ্য দক্ষিণ কোরিয়া

দক্ষিণ কোরিয়ার এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় হলো সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ল্যাবে একজন শিক্ষার্থী এসেছেন। তাঁর নাম জেই হুন। ঝাঁকড়া চুল। ছাব্বিশ বছর বয়সের এই ঝানু শিক্ষার্থী এসেছেন পোস্টডক করতে। আমেরিকার একটা আইভিলিগ স্কুলে রিসার্চ করতে এসে ছেলেটি খুব খুশি। দিন-রাত মৌমাছির মতো খাটছেন। দুই বাটি খাবার নিয়ে আসেন। দুপুর-সন্ধ্যা ল্যাবেই খান। আমি তাঁর কাছ থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার অগ্রগতির গল্প শুনি। জ্ঞান-গবেষণায় কী করে তাঁর দেশ টর্পেডোর মতো ছুটছে, সে বয়ান শুনে চক্ষু বড় হয়ে যায়।

chardike-ad

দক্ষিণ কোরিয়ার জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। এই দেশটা মোটামুটি মানের ফুটবল খেলে। এ ছাড়া, এই দেশটাকে চেনার তেমন কিছু নেই। তবে এই দেশটি এখন একটা বিষয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। সেটা হলো ‘গবেষণায় বরাদ্দ’। দেশটা তার জিডিপির প্রায় সাড়ে চার ভাগ অর্থ গবেষণায় ব্যয় করে। দুনিয়ার আর কোনো দেশ তার জিডিপির এত অর্থ ব্যয় করে না। দক্ষিণ কোরিয়ার পরে আছে ইসরায়েল। তার বহু পরে আমেরিকা, চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। কী অবিশ্বাস্য! গবেষণার চারটা খাত ওরা বেছে নিয়েছে—বায়োলজিক্যাল, কেমিক্যাল, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞান। তাদের লক্ষ্য, আগামী পঞ্চাশ বছরে উদ্ভাবন-আবিষ্কারে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ হওয়া। পৃথিবীর ছোট্ট একটা দেশ তাদের। তারা চাইতে পারত, খেলায় বড় হতে। শিল্প-সংস্কৃতিতে বড় হতে। তারা চাইতে পারত বাণিজ্যে বড় হতে। কিন্তু তারা চাচ্ছে আবিষ্কার-উদ্ভাবনে বড় হতে। লক্ষ্যটা কত গভীর!

এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যের জন্য প্রচুর অর্থ ঢালছে এই দেশ। তাদের মেধাবীরা চলে যেত আমেরিকায়। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার পিএইচডি শিক্ষার্থীদের বেতন দিল বৃদ্ধি করে। জেই হুন বললেন, পিএইচডির সময় তিনি মাসে দুই হাজার ইউএস ডলার সমতুল্য বেতন পেয়েছেন। তারপরও তাদের মেধাবীদের আটকানো যাচ্ছে না। সরকার দেখল, দক্ষিণ কোরিয়ার যুবকেরা যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করে সেখানেই থেকে যেতে চায়। সেসব তরুণদের ফিরিয়ে নিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করা শুরু করল সরকার। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে না। দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন সে দেশের সেরা সেরা মেধাবীদের ঢোকানো হচ্ছে। মুখ দেখে কাউকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয় না। দল দেখে নিয়োগ দেওয়া হয় না। কোটাভিত্তিক নিয়োগ সেখানে চলে না। কাজ করতে করতে কোরিয়ার একেকজন অধ্যাপকের ত্রাহি ত্রাহি দশা। পদোন্নতি সেখানে মুখ দেখে আর দল দেখে পাওয়া যায় না।

এই সব প্রচেষ্টার ফলাফল হলো, গত বিশ বছরে দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণার মান পৃথিবীর সেরা দেশগুলোকে স্পর্শ করেছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় উঠে এসেছে। কোরিয়ায় প্রতি হাজারে, প্রায় তেরো জন মানুষ গবেষক। পৃথিবীতে তাদের আগে মাত্র তিনটি দেশ এই বিষয়ে এগিয়ে। আমেরিকার ক্ষেত্রে সে সংখ্যাটা নয়। জ্ঞানকে স্বাগত জানাতে তারা ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী নিচ্ছে। মেধাবীর জন্য দক্ষিণ কোরিয়া তার দুয়ার খুলে দিয়েছে আজ! তরুণদের বলছি, কোরিয়ার সুযোগগুলো লুফে নাও। তাদের ল্যাবগুলোতে স্থান করে নেওয়ার চেষ্টা করো। গবেষণায় কোরিয়া এখন লিডিং পজিশনে যাচ্ছে। তাদের কাছ থেকে শিখতেই হবে আমাদের। অপ্রতিরোধ্য কোরিয়ার কাছ থেকে অর্জন করে নাও, যতটুকু সম্ভব!

লেখকঃ ড. রউফুল আলম

গবেষণা হলো একটা সংস্কৃতি। এটা গড়ে তুলতে হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় সেটা গড়ে উঠেছে। এখন শুধু উত্তরোত্তর বাড়ছে। বাঁশগাছের মতো বর্ধিঞ্চু তাদের গবেষণার সফলতা ও খ্যাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপান তার উগ্র জাতীয়তাবাদ আর যুদ্ধংদেহী মনোভাব ঝেড়ে ফেলে গবেষণায় মেতে উঠেছিল। আর সে হাওয়া লেগেছিল চীন ও কোরিয়াতেও। আমার কাছে সে সময়টাকে পূর্ব এশিয়ার রেনেসাঁ মনে হয়। শুধু সত্তরের দশক পরবর্তী সময়ে, দুই ডজন নোবেল পুরস্কার ঘরে তুলেছে জাপান!

দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণা বিস্তৃত। তারা মহাকাশ নিয়ে কাজ করে। গবেষণা করে ন্যানো মেডিসিন নিয়ে। গবেষণা করে মাইন-ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে। মৌলিক গবেষণায় তারা এখন এশিয়াতে চীন-জাপানের সমতুল্য। চাট্টিখানি কথা নয়! তাদের বিশ্ববিদ্যালয় এখন জগৎ সেরা। সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এখন দুনিয়ার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান। পোহান, চনবুক, পুসান, চোনাম ইত্যাদি নামে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আছে, সেগুলো এখন সাড়া জাগানো প্রতিষ্ঠান। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েরা ইউরোপ-আমেরিকায় এসে গবেষণা করছেন।

গত পাঁচ দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষণা কোথায় চলে গেছে, সেটা জানার জন্য সে দেশের তরুণ ও গবেষকদের সঙ্গে আপনাকে কথা বলতে হবে। তাঁদের চিন্তাভাবনা ও দূরদর্শিতা দেখে থ হয়ে যেতে হয়। আগামী পঞ্চাশ বছরে তারা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান—এমনই বলেছিলেন চনবুক ইউনিভার্সিটির একজন অধ্যাপক। গবেষণায় তাদের অস্ত্র একটাই—মেধা! মেধার প্রশ্নে, তাঁদের জিরো কম্প্রোমাইজ! আর, ছেলেমেয়েরা সে দেশে কী পরিমাণ কাজ করছে, সেটা অকল্পনীয়।

দক্ষিণ কোরিয়া আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে ছোট। কিন্তু আয়তন দিয়ে কী আসে যায়! দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে চোখটাকে খোলা রাখতে হয়। দেখতে হয়। শিখতে হয়। দেশ ছোট হলে চলে, চোখ ছোট হলে চলে না!

ড. রউফুল আলম: রসায়ন গবেষক, যুক্তরাষ্ট্র।
ইমেইল: <rauful.alam15@gmail.com>;