Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ভারতে হিন্দুদের ধর্মত্যাগ, কী করবেন মোদি?

Modi
গুজরাটে ধর্মত্যাগের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কপালে ভাঁজ ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিরোধীরাও রাজনীতির মাঠে ব্যবহার করবে এই ট্রাম্পকার্ড। ছবি: রয়টার্স গুজরাটে ধর্মত্যাগের ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কপালে ভাঁজ ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিরোধীরাও রাজনীতির মাঠে ব্যবহার করবে এই ট্রাম্পকার্ড।

চলতি মাসেই হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল ভারত। আবার কি আসছে প্রতিবাদের ঢেউ? লক্ষণ কিন্তু তা-ই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটেই ঘটে গেছে ধর্মত্যাগের ঘটনা। তাও একজন-দুজন নয়, তিন শতাধিক। এ যেন মোদির রাজনৈতিক দলের হিন্দু মাতৃভূমি গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় সজোরে চপেটাঘাত!

ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিম্নবর্ণের মানুষ দলিত বলে পরিচিত। সমাজে উচ্চবর্ণের অনেকে তাদের অস্পৃশ্য মনে করে।

chardike-ad

নির্যাতনের বিচার না পেয়ে গুজরাটে ঘোষণা দিয়ে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছেন দলিত সম্প্রদায়ের তিন শতাধিক মানুষ। গতকাল রোববার এ ঘটনা ঘটে রাজ্যের উনা শহরে। ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) গোরক্ষকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার দুই বছর পরও সুবিচার না পেয়ে ধর্মত্যাগের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁরা। হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন তাঁরা।

এই ঘটনার কারণ জানতে হলে ফিরতে হবে ২০১৬ সালে। ভারতজুড়ে তখন শুরু হয়েছে বিজেপির নেতা-কর্মীদের গোরক্ষা কর্মসূচি। কসাইখানার দিকে গরু নিয়ে যেতে দেখলেই পথ আগলে দাঁড়াত গোরক্ষকেরা। আর চলত মারধর। ওই বছরের ১১ জুলাই উনা শহরের মোতা সামাধিয়ালা গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের চারজন ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়। গরুর চামড়া ছাড়ানোর অভিযোগ তুলে এই শাস্তি দিয়েছিল গোরক্ষা কমিটির লোকেরা।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, ওই চারজন একটি মৃত গরু নিয়ে এসেছিলেন। গোহত্যা করেননি। কিন্তু গরুর চামড়া ছাড়ানোর সময় ছয় ব্যক্তি এসে তাঁদের বিরুদ্ধে গোহত্যার অভিযোগ তোলে। ওই চার দলিত অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁরা গোহত্যা করেননি। চামড়া বিক্রির জন্যই মৃত গরু নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শুরু হয়ে যায় মারধর। প্রথমে লোহার পাইপ, পরে রড দিয়ে পেটানো হয় তাঁদের। এরপর অর্ধনগ্ন করে গাড়ির পেছনে বেঁধে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের ভেতরে। সেখানে আরেক দফা পেটানোর পর গাড়ি করে নেওয়া হয় উনা শহরে। শহরে নিয়ে আবার বাঁধা হয় গাড়ির সঙ্গে। এরপর প্রকাশ্যে ফের পেটানো হয় তাঁদের। সবশেষে ওই চার ব্যক্তিকে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে।

এই ঘটনার ছবি এবং ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরই সূত্র ধরে দেশজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল বিক্ষোভ।

গতকাল বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করা দলিতদের একজন হলেন বালু সারাভাইয়া। স্ত্রী-সন্তানসহ তাঁর পুরো পরিবারই হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছে। বালু সারাভাইয়া বলছেন, দলিত সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতেই এভাবে ধর্মত্যাগ করেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনায় আমাদের ছেলেদের নিষ্ঠুরভাবে পেটানো হয়েছিল। দুই বছর হয়ে গেলেও তার কোনো বিচার হয়নি। রাজ্য সরকার আমাদের কোনো সাহায্যও করেনি। আর যারা পিটিয়েছিল, তারা সবাই জামিনে বের হয়ে গেছে।’

ইন্ডিয়া টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভারতে দলিত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রতিদিন দলিত সম্প্রদায়ের ছয়জন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। ২০০৭ থেকে ২০১৭—এই ১০ বছরে ভারতে দলিত নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর থেকে গুজরাটেও বেড়ে গেছে দলিত নির্যাতনের হার।

তবে ধর্মত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানোর পরই এক দফা হুমকি পেয়ে গেছেন সারাভাইয়া। সেই হুমকি আবার দিয়েছেন আগের নির্যাতনকারীরাই। সারাভাইয়া বলেন, ‘ওই ঘটনার পর দলিতদের মধ্যে বিপুল ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। আমরা ছিলাম তার মূল বিষয়। এ কারণেই আরও বেশি বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে আমাদের। এখনো সেই পেটানোর ভিডিও দেখলে আমরা ভয়ে শিউরে উঠি।’

দিল্লি স্কুল অব ইকনোমিকসের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নন্দিনী সুন্দরের মতে, তিনটি কারণে দলিতদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বাড়ছে। একটি হলো হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে দোষী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি বা বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অন্যটি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের পুনরুত্থান। তৃতীয় কারণটি হলো দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বিক্ষোভ। মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করায় দলিতদের ওপর এখন অত্যাচার হচ্ছে আরও বেশি। যেভাবেই হোক তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।

২০১৬ সালে গোরক্ষার দোহাই দিয়ে প্রকাশ্যে পেটানোর ঘটনার পর এ মাসের শুরুর দিকে আবার বড় বিক্ষোভের জন্ম দেয় দলিতরা। এপ্রিলের ২ তারিখে কিছু দলিত গোষ্ঠীর ডাকা ‘ভারত বন্‌ধ্‌’-এ সারা দেশেই তোলপাড় শুরু হয়েছিল। সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া এক রায়ের প্রতিবাদে এই বন্‌ধ্‌ ডাকা হয়েছিল। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের (শিডিউলড কাস্ট ও শিডিউলড ট্রাইব) বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ করতে ১৯৮৯ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। আদালত সেই আইনের কিছু কঠোর বিধান পরিবর্তনের আদেশ দেওয়াতেই প্রতিবাদস্বরূপ হরতাল ডাকা হয়। তখন ভারতের ১০টি রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। এ সময় দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে পুলিশ ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। নিহত হয় ১১ জন।

এবার এল ধর্মত্যাগের ঘটনা। এটি যে একটি অভিনব প্রতিবাদ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তা যখন হয় মোদির রাজ্য গুজরাটে, তখন অবশ্যই তা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর পদে থেকেই কেন্দ্রের টিকিট কেটেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। অথচ সেখানেই নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে ধর্মত্যাগ করতে হচ্ছে দলিতদের।

সমালোচকেরা বলছেন, ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম আদতে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে নেই। এটি চলে গেছে রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের (আরএসএস) হাতে। আর দলিতদের জন্য কোনো সহানুভূতি নেই আরএসএসের। যে হিন্দু মাতৃভূমির কথা এই সংগঠন বলে, তাতে দলিতরা অস্পৃশ্য। সেখানে শুধু ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়দের জয়গান। তাই দলিত সম্প্রদায় উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা নেই কারও।

উনায় বেশ বড় অনুষ্ঠান করেই ধর্মত্যাগ করেছেন দলিত সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী। এ জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটিও করা হয়। অন্যতম সংগঠক বালু সারাভাইয়া দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘নির্যাতনকারীরা বরাবরই বলে আসছে, দলিত হওয়ার কারণেই আমরা নাকি হিন্দু নই। এসব আর নেওয়া যাচ্ছে না। বাবাসাহেব ভিমরাও আম্বেদকার যেমন নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ীই আমরা সম্প্রদায় সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ জন্যই ধর্মত্যাগ করেছি। তবে এটি করার মাধ্যমে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য করছি না আমরা।’ অবশ্য দলিত সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান নেতারা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না।

দলিতদের আগেকার প্রতিবাদ-বিক্ষোভে দেখা গেছে, সেগুলো খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রতিবাদের পথ হিসেবে ধর্মত্যাগ কতটা উপযুক্ত, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। কিন্তু এটি যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কপালে ভাঁজ ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিরোধীরাও রাজনীতির মাঠে ব্যবহার করবে এই ট্রাম্প কার্ড। মোদির নিজের রাজ্যেই যদি দলিতরা নিরাপদ বোধ না করেন, তবে সারা দেশে কী অবস্থা! -প্রথম আলো থেকে