Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

ঠিকাদারের এত ক্ষমতা!

amin-housingঅবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযানের ১১তম দিনে এসে গত মঙ্গলবার বছিলা এলাকায় তুরাগ নদের পাড়ে ‘আমিন মোমিন হাউজিং লিমিটেড’ নামে হাউজিং প্রকল্প উচ্ছেদে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। প্রভাবশালী ঠিকাদার রকিবুল আলম দীপু ও তার লোকজনের বাধার মুখে অভিযান স্থগিত করে ফিরে আসতে বাধ্য হন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। বুধবার ওই আবাসিক প্রকল্পের সেমিপাকা ও আধাপাকা অবৈধ স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পটি ঘেঁষে নদীর একেবারে তীরে গড়ে তোলা ১০ তলা ভবনটি উচ্ছেদ না করেই নদী দখলমুক্ত করার অভিযানটি শেষ করেছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে স্থানীয় জনগণ এবং সচেতন মহলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে, যার ঢেউ লাগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। সংশ্নিষ্ট ‘ঠিকাদারদের’ ক্ষমতার উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তারা একবার বলছেন, ১০ তলা ভবনটির মালিকানা নিশ্চিত হতে পারেননি। আবার বলছেন, সুউচ্চ এ ভবন ভাঙার মতো যন্ত্রপাতি তাদের নেই। যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে শিগগিরই তা ভেঙে ফেলা হবে।

chardike-ad

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি ও লেখক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, বছিলায় ওই ১০ তলা অবৈধ ভবনটি ভেঙে ফেলার দাবিতে বাপার পক্ষ থেকে তারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। এবারের উচ্ছেদ অভিযান শুরুর পর তারা আশা করেছিলেন, সেটিও ভাঙা হবে। কিন্তু ভবনটি এখনও পর্যন্ত ভাঙা হয়নি। এটি অবশ্যই ভাঙতে হবে। নতুবা উচ্ছেদ অভিযান পূর্ণতা পাবে না। বড় ভবন না ভেঙে ছোট ছোট অবৈধ স্থাপনা ভাঙা এক এক ধরনের অবিচার ও বৈষম্য।

এই ভবনটি ভাঙার মতো যন্ত্রপাতি বিআইডব্লিউটিএর নেই বলে সংস্থাটির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইলে আবুল মকসুদ বলেন, র‌্যাংগস ভবন যদি ভাঙা যায়, তাহলে এটি কেন ভাঙা যাবে না? সত্যিই যদি তাদের যন্ত্রপাতি না থাকে, তাহলে সেগুলো সংগ্রহ করেই ভবনটি ভাঙা হোক। তাহলেও তো মানুষ আশ্বস্ত হবে।

চার পর্যায়ে চলা মোট ১২ দিনের এই অভিযানকালে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগতীরের ১৭ শতাধিক ছোট-বড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রায় ২৪ একর তীরভূমি। এখন বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো ঘিরে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরুর অপেক্ষায় সরকার।

দেশের নদ-নদীগুলো রক্ষায় সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিআইডব্লিউটিএ এ উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করে।

কে এই দীপু :তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে ‘এসএস রহমান ইন্টারন্যাশনাল’-এর স্বত্বাধিকারী রকিবুল আলম দীপু কোনো রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন প্রকল্প ও নির্মাণকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় নিজ প্রতিষ্ঠানের অংশীদার করেছেন সংস্থার সাবেক দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। তাদের একজন বিআইডব্লিউটিএর সাবেক সচিব সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, যিনি বিএনপি নেতা সাবেক হুইপ শহীদুল হক জামালের আপন চাচাতো ভাই। মনোয়ার হোসেন ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় শহীদুল হক জামালের প্রভাব কাজে লাগিয়ে জোরজবরদস্তি করে সংস্থার সচিব পদ বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপুর ব্যবসার আরেক অংশীদার বিআইডব্লিউটিএর সাবেক উপপরিচালক শরীফ আফজাল হোসেন। এ দুই কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর দীপুর ব্যবসার অংশীদার হন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঠিকাদার দীপু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করেছেন। অবশ্য ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিআইডব্লিউটিএর বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠলে দীপুসহ সংস্থার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও আত্মগোপনে ছিলেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিকেও বেশ কিছুদিন চুপচাপ ছিলেন তিনি। চার-পাঁচ বছর ধরে আবারও সক্রিয় হয়ে বিআইডব্লিউটিএর ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তুরাগপাড় দখল ও নদীর তীরভূমি ভরাট করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা ‘আমিন মোমিন হাউজিং লিমিটেড’ প্রকল্পের সঙ্গেও দীপুর সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় মোহাম্মদ তোবারক হোসেন তুরাগপাড়ের প্রায় ১১ একর জায়গা দখল করে এই হাউজিং প্রকল্প গড়ে তোলেন, যার অন্যতম অংশীদার হচ্ছেন তিনি। এই হাউজিং প্রকল্পে অভিযান শুরুর আগে তার নামে প্রকল্প এলাকায় অসংখ্য সাইনবোর্ডও দেখা যায়। যেগুলোতে লেখা ছিল- ‘এই জমির মালিক রকিবুল আলম দীপু, এস এস রহমান গ্রুপ’।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলমান উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে দীপু তুরাগপাড়ে হাউজিং প্রকল্পসহ তার দখলকৃত অবৈধ স্থাপনা যাতে উচ্ছেদ না হয়, সে জন্য তদবির-লবিং করে আসছিলেন। এমনকি বিদেশে অবস্থানরত বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করতে দেশের বাইরেও যান বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে কর্মকর্তাদের অনড় অবস্থানের মুখে মঙ্গলবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলে দেশের বাইরে থেকেই সেটি বন্ধে তৎপরতা চালান। তার পক্ষে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী পরিচয় দেওয়া স্থানীয় কয়েক যুবক মোটরসাইকেলে উচ্ছেদ অভিযানে বাধা দিতে এলে একজন আটকও হন। পরে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।

এর পরই দীপু বিদেশে বসেই বিআইডব্লিউটিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযান বন্ধে তৎপরতা শুরু করেন। এর একপর্যায়ে বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের পরিচালক শফিকুল ইসলামের মোবাইল ফোনের নির্দেশে অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা সংস্থার যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন অভিযান বন্ধ করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। প্রভাবশালী মহলের চাপে আরিফকে অভিযান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে- এমন গুঞ্জন উঠলেও বুধবার এই কর্মকর্তার নেতৃত্বেই অভিযান চালিয়ে সেখানকার অবৈধ স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে রকিবুল আলম দীপু বলেন, চার-পাঁচ দিন আগেই বাবার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন তিনি। বিদেশে বসেই তিনি জানতে পারেন, বছিলায় তুরাগপাড়ে আমিন মোমিন হাউজিং প্রকল্পের দখল করা জায়গায় কে বা কারা তার নামে অনেকগুলো সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। উচ্ছেদ অভিযান শুরুর আগের রাতেও (সোমবার) এসব সাইনবোর্ড ছিল না বলে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারাই জানিয়েছেন তাকে। তার ব্যবসায় ঈর্ষান্বিত একটি মহল তাকে হেয় করতে এবং প্রচার পেতেই ওইসব সাইনবোর্ড টানিয়েছে। অথচ ওই জায়গায় তার এক ইঞ্চি জমিও নেই। জায়গাটি ঠিক কোথায়, সেটিও ভালোভাবে চেনেন না তিনি। ফলে তার বিরুদ্ধে ওঠা নদীর জমি অবৈধ দখলের অভিযোগ একেবারেই অবান্তর।

এক প্রশ্নের জবাবে দীপু দাবি করেন, আমিন মোমিন হাউজিং প্রকল্পের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এর মালিক কারা, কারা এটি পরিচালনা করেন- সেটাও জানেন না তিনি। ওই প্রতিষ্ঠানের কাউকে চেনেনও না। ঠিকাদারি কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ওয়ান-ইলেভেনের সময় আত্মগোপনে থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানটি গত ৪০ বছর সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। আগে তার বাবা ছিলেন এর মালিক। আর তিনি বিদেশ থেকে লেখাপড়া শেষ করে এসে ২২ বছর ধরে এর হাল ধরেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আজ পর্যন্ত ওঠেনি।

বুধবারের চিত্র: বুধবার সকাল ৯টায় বছিলায় তুরাগের পাড় দখল করে গড়ে তোলা ‘আমিন মোমিন হাউজিং প্রকল্পের’ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু হয়। দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে পুরো হাউজিং প্রকল্পটিই গুঁড়িয়ে দিয়ে নদী দখলমুক্ত করা হয়। এদিন ওই এলাকা থেকে মোট ৪৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এর মধ্যে ছিল ১২টি পাকা ভবন (তিনটি দোতলা ও নয়টি একতলা), পাঁচটি আধাপাকা ভবন, দুটি টিনশেড ভবন ও ৩০টি সীমানাপ্রাচীর (প্রতিটি ১০০ ফুট করে)। এ সময় সেখানে রাখা ১৩টি ইটের স্তূপও অপসারণ করা হয়।

অভিযান স্থগিত করার আগে মঙ্গলবার সেখান থেকে আরও ৩৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। যার মধ্যে ছিল তিনটি একতলা পাকা ভবন, ১১টি আধাপাকা ভবন, ১৫টি টংঘর ও ১০টি সীমানাপ্রাচীর। এ দু’দিনে প্রায় ১১ একর ভরাটকৃত জায়গা অবমুক্ত করা হয়, যা এক্সক্যাভেশন ও ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীপ্রবাহ ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তবে ওই হাউজিং প্রকল্প এলাকার বাইরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা একটি ১০ তলা ভবন বুধবার পর্যন্ত উচ্ছেদ করতে পারেননি বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। উচ্ছেদ অভিযানের তত্ত্বাবধানে থাকা বিআইডব্লিউটিএর ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, এত বড় একটি ভবন ভাঙার মতো বুলডোজার ও যন্ত্রপাতি তাদের কাছে না থাকার কারণেই ভবনটি ভাঙতে পারেননি তারা। এসব যন্ত্রপাতির জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছে রিক্যুইজিশন দেওয়া হয়েছে। রাজউকের সহযোগিতা নিয়ে শিগগিরই ওই ভবনে অভিযান চালাবেন তারা।

এবারের অভিযানে কী হলো :উচ্ছেদ অভিযানে নামার আগেই বিআইডব্লিউটিএ থেকে একটি তালিকা করে কামরাঙ্গীরচর থেকে পানগাঁও পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের দু’তীরের ১২ কিলোমিটার অংশে ৯০৬টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের টার্গেট করা হয়েছিল। অভিযানে নেমে তালিকার বাইরে আরও অনেক অবৈধ স্থাপনার খোঁজ মেলে।

২৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে বুধবার পর্যন্ত চার পর্যায়ের উচ্ছেদ অভিযানকালে মোট এক হাজার ৭০৮টি ছোট-বড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ কে এম আরিফ উদ্দিন জানিয়েছেন, চার পর্যায়ের ১২ দিনের অভিযান শেষ হলেও আবার উচ্ছেদ অভিযানে নামবেন তারা। শিগগির পরবর্তী অভিযানের দিনক্ষণ ও স্থান নির্ধারণ করে জানিয়ে দেওয়া হবে।

সৌজন্যে- সমকাল