Search
Close this search box.
Search
Close this search box.

প্রয়োজন নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার নৈতিক অধিকার

কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির:

বর্তমানে বাংলাদেশে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৭ বছর বয়সী ঢাকাস্থ অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলে পড়ুয়া মেয়ে ঐশী কর্তৃক নির্মমভাবে তার বাবা-মা খুন। শিক্ষাসনদ অনুযায়ী ঐশীর জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৯৬এ। বাবা মাহফুজুর রহমান ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার একজন কর্মকর্তা, মা স্বপ্না রহমান।

chardike-ad

61819_1596610921344_1145409_n১৯৭৪ এর ২(চ) ধারানুযায়ী ঐশী প্রাপ্ত বয়স্কা, কেন না এ ধারায় ১৬ বছরের কম বয়সীদেরকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৩ সালে যে শিশু আইন প্রণীত হয়েছে তাতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে গণ্য করা হবে। সদ্য প্রণীত এ আইনটি কার্যকরি হবে ২৫ আগস্ট ২০১৩ থেকে। শিশু হোক আর প্রাপ্ত বয়স্কা হোক, পত্রিকার তথ্যমতে মেয়েটি তার বাবা-মাকে ঘুমন্ত অবস্থায় ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তার বাবা-মায়ের খুনের বিভৎস ঘটনার বর্ণনা করেছে সে। বর্ণনা করেছে ঘটনার পূর্বাপর কাহিনীও। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টকশো, ব্লগ বেশ গরম বিষয়টি নিয়ে। কেউ খুঁজছেন এ অঘটনের কারণ, কেউ মানবাধিকারের কথা বলছেন, কেউ ঐশীর চিকিৎসার কথা বলছেন আবার কেউ বলছেন খুনির কি শাস্তি হওয়া উচিৎ। কারণ হিসেবে কেউ দুষছেন ঐশীকে, তার বেপরোয়া জীবন যাপন বা মাদকাশক্ততাকে, কেউ দুষছেন তার বন্ধুদের, কেউ তার বাবার অঢেল অবৈধ অর্থকে আবার কেউ দুষছেন আমাদের বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে। যাই হোক, ভেতরে ভেতরে আমাদের সমাজ কতটা ক্ষয়ে গেছে, কতটা নষ্ট হয়ে গেছে, নৈতিকতার কতটা অধঃপতন ঘটেছে তা ঐশীর এ ঘটনা থেকে দিবালোকের মত দৃশ্যমান হয়েছে।

ঐশী নামের সাথে আধ্যাত্বিকতার একটা মিল পাওয়া যায়। মহান আল্লাহর ঐশীবাণী ওহীর মাধ্যমে নাযিল হয়েছে। নাযিলকৃত সে বাণীসমূহ বা আল-কোরআন মুত্তাকিনদের (পরহজগোর) জন্য পথর্প্রদশক (আল-কোরআন, সুরা-২, আয়াত-২)। ওহী ঐশীর ছোট ভাই। বাবা-মা অনেক আদর করে তাদের সন্তানদের এমন তাৎপর্যপূর্ণ নাম রেখেছিলেন। বোঝা যায় ধর্ম বিশ্বাস কমবেশী ছিল তাদের মধ্যে। অন্য বাবা-মায়ের মত ঐশীর বাবা-মাও কখনও চিন্তা করেননি নিজ সন্তানের হাতে এভাবে খুন হবেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ঘটনাটি অতি মাত্রায় বিভৎস। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি তার বাবা-মা ঐশীকে ভালোবাসতেন না? নাকি ভালোবাসায় ঘাটতি ছিল? অন্য দশটা বাবা-মায়ের মত এ পুলিশ দম্পতিরও ছিল তাদের সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া।

ঐশীকে তার বাবা-মা অসম্ভব ভালোবাসতেন আর সে কারণেই মেয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে তাকে প্রচুর টাকা খরচ করে একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাদের সন্তান অনেক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। আদর, ভালোবাসা, মায়া, স্নেহ, আর্থিক নিশ্চয়তা সবই দিয়েছেন উজাড় করে। বলতে পারেন নৈতিক শিক্ষার অভাব ছিল। নৈতিকতার শিক্ষাও হয়তো দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে স্পষ্ট যে সে নৈতিক শিক্ষা ঐশীকে ফেরাতে পারেনি। প্রশ্নটা সেখানেই, কেন ফেরাতে পারেনি ঐশীকে? এর পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ আছে। জানা যায়, মাসে কয়েক লাখ টাকা শুধু হাত খরচের জন্য দেওয়া হতো তাকে। ডিজে পার্টি, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, ইয়াবাসহ বিভিন্ন নেশা করা এগুলো ছিল ঐশীর নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রশ্ন থেকে যায় একজন সরকারি কর্মকর্তা কোথা থেকে এত টাকা আয় করতেন? মোটামুটি পরিষ্কার যে ঐশীর বাবার উপার্জন সৎপথে ছিল না।

নিজের বাবা-মাকে খুন করার মত জঘন্য কাজ করার জন্য মনের একটা বিশেষ অবস্থার প্রয়োজন হয়। যে অবস্থায় হিতাহিত বুদ্ধি কাজ করে না। একটা পর্যায়ে গিয়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির কাছে তার জীবনের প্রয়োজনে মাদক নেওয়াকেই পৃথিবীর এক নম্বর প্রয়োজন মনে হয়। বাবা-মা ভাই বোন তার কাছে তুচ্ছ মনে হয় বরং সবাইকে তখন সে চরম শত্রু ভাবা শুরু করে। এ অবস্থাকে প্যারানয়া বলে। ঐশীর ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে থাকতে পারে। দুই বছর ধরে ঐশী ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত। কেন তাকে উচ্ছৃখল জীবন যাপনে বাধা না দিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে? তিন মাস আগে বাবা-মা যখন বুঝতে পেরেছেন মেয়ে অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যদি প্রথম থেকে খেয়াল রাখা যেত যে মেয়ে কাদের সাথে ঘুরে, কোথায় যায়, কি করে, এত টাকা কি করে তাহলে এমনটা নাও হতে পারতো। আমার ধারনা ঐশীর বাবা-মা তাদের মেয়ের দিকে খেয়াল রাখার নৈতিক অধিকার হারিয়েছিলেন।

আসুন বিষয়টা খোলাশা করি। কোন বাবা-মা চান না তাদের আদরের সন্তান নৈতিকতা বিবর্জিত হয়ে গড়ে উঠুক। তাই আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করি আমাদের সন্তানদের সেভাবে গড়ে তোলার। এজন্য আমরা কমবেশি ধর্মের আশ্রয় নিই। পরিবার হচ্ছে একটি শিশুর প্রথম স্কুল যেখানে সে তার বুনিয়াদি শিক্ষা পেয়ে থাকে। একটু একটু করে নৈতিক শিক্ষার বীজ শিশুর মধ্যে প্রবেশ করে। সে শিক্ষা সারাজীবন তাকে পরিচালিত করে। সে স্কুলের শিক্ষক প্রধানত দুইজন, বাবা আর মা। কাজেই শিক্ষক হিসেবে থাকতে হয় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা, থাকতে হয় শিক্ষা দেওয়ার নৈতিক অধিকার। নিজে যদি অন্যায় কাজ করি তাহলে অন্য কাউকে অন্যায় কাজে নিষেধ করার বা বিরত রাখার নৈতিক অধিকার থাকার কথা নয়। আর চেষ্টা করলেও ফলাফল কম ক্ষেত্রেই পজিটিভ হয়। অভিভাবক হিসেবে আমরা নিজেরা যদি বেপরোয়া জীবন যাপন করি, ডিজে পার্টিতে যাই, অবৈধ পথে টাকা আয় করি, বিভিন্ন প্রকার নেশাজাতীয় দ্রব্যে ডুবে থাকি, আধুনিকতার নামে একাধিক পরপুরুষ বা নারীর সাথে রাত কাটাই তাহলে স্বভাবতই আমাদের সন্তানদের সেসব কাজ করতে নিষেধ করার নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলি।

কোনো অভিভাবক যদি তার সন্তানের জন্মদিনে খুব দামি একটা উপহার দেয় তাহলে সব সন্তানই অসম্ভভ খুশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। সন্তান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলবে- তুমি এ জগতের শ্রেষ্ঠ বাবা। কিন্তু যখন সে সন্তান জানতে পারবে তার বাবা যে উপহারটা দিয়েছিল তা ছিল অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থে কেনা তখন তার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মনের অজান্তেই শিশুটির মনে বাবার প্রতি ঘৃণার জন্ম হবে। শ্রদ্ধাবোধ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। এভাবেই ফাটল ধরে বাবা-সন্তান সম্পর্কে, ফাটল ধরে পারিবারিক বন্ধনে যদিও শিশুটির প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় শিশুটি বাবা-মাকে আর তোয়াক্কা করবে না, চলবে নিজের খুশিমত, উৎসায়িত হবে বাবার মত অবৈধ পথে যেতে। কোন স্নেহের টানই তাকে আর ফেরাতে পারবে না। পক্ষান্তরে, বাবা-মায়ের সাধ্যের বাইরে সন্তান কোন আবদার করলে যদি নিজেদের অপারগতার কথা সন্তানকে বোঝানো হয়, বোঝানো হয় বাস্তবতাকে তাহলে আপাতভাবে শিশুটি মন খারাপ করলেও যখন সে বুঝতে পারবে সঙ্গত কারণেই বাবা সে আবদার পূরণ করতে পারেননি তখন বাবার প্রতি শ্রদ্ধা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

অন্য সবার কাছে সে তার বাবার সততার জন্য গর্ব করবে। এ অবস্থায় বাবা কোনো আদেশ দিলে বা নিষেধ করলে শ্রদ্ধার সাথে সে আদেশ নিষেধ পালন করার চেষ্টা করবে। পরিবারের মধ্যে বিরাজ করবে অটুট বন্ধন। শান্তির নীড়ে পরিণত হবে ঘর। সুতরাং সন্তানকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার আগে নিজে সে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নিজের জীবনে সে শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই নিজের মধ্যে নৈতিক অধিকার জন্মাবে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার। মহানবী (সা.) এর কাছে একদা এক ব্যক্তি তার ছেলের মিষ্টি বেশি খাওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসেন। ছেলেকে বলে দিতে বলেন যেন সে মিষ্টি কম খায়। মহানবী (সা.) পরবর্তী কোনো একদিন আসতে বলেন। পরবর্তী একদিন আসলে তাকে আবারও ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর মহানবী (সা.) লোকটার ছেলেকে মিষ্টি কম খেতে বলেন। বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে মহানবী (সা.) বলেন, আমিও মিষ্টি বেশি খেতাম। এই কয়েকদিনে আমি মিষ্টি কম খাওয়ার অভ্যাস করেছি। নিজে যেটা পালন করি না অপরকে সেটা করতে বলা সমীচীন নয়। এ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কাউকে কোন উপদেশ দেওয়ার আগে নিজে সেটা মেনে চলতে হবে। অনেকে বলতে পারেন নৈতিকতা শিক্ষার জন্য শুধু ধর্মের আশ্রয় কেন নিতে হবে, অন্যভাবেও তো শেখানো যায়। তাদের উদ্দেশ্যে বলি ধর্ম হচ্ছে হাজার বছর ধরে পরীক্ষিত নির্ভুল একটি বিষয় যার কাছে আত্মসমর্পণ করা যায় নিশ্চিন্তায়।

পক্ষান্তরে, নিজেদের খুশিমত ভেবে নেয়া পদ্ধতিতে ভুল থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে আমাদের সন্তান ঐশীর মত হয়ে গেলে তা অস্বাভাবিক হবে না। লক্ষ্য করলাম স্কুলের ধর্ম বইয়ের নাম পরিবর্তন করে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা রাখা হয়েছে। প্রশ্ন জাগে মনে তাহলে ইসলাম ধর্মে কি নৈতিক শিক্ষা অর্ন্তভুক্ত নেই? এ রকম নামকরণের মাধ্যমে পক্ষান্তরে ইসলামকে ছোট করা হয়েছে বা ইসলামের নৈতিক শিক্ষাকে অস্বীকার করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে ইসলাম সব সময়ই আধুনিক, সব সময়ই অগ্রগামী একটা ধর্ম। যারা মনে করেন ইসলাম সেকেলে ধর্ম তারা ভুলের মধ্যে আছেন। আসুন নৈতিক শিক্ষার জন্য আমরা নিজেরা ধর্মাশ্রয়ী হই এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলি সাথে সাথে আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার জন্য ইসলাম শিক্ষার (অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তাদের ধর্ম শিক্ষা) উপর নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেই, ধর্মীয় মূল্যবোধে তাদের গড়ে তুলি। প্রাণপ্রিয় সন্তানের দিকে চেয়ে হলেও আমাদের অর্জন করতে হবে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার নৈতিক অধিকার।

আমাদের সমাজের মাঝে থাকা হাজারো ঐশী কর্তৃক এ রকম অঘটন ঘটার আগে অবশ্যই আমাদের সতর্ক হতে হবে। তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সুস্থ্য জীবনে। আমাদের ভুলের জন্য আর যেন কোনো ঐশীর জন্ম না হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য এ অধিকার অর্জন করা আজ বড্ড প্রয়োজন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
বর্তমানে গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভাসিটি, সাউথ কোরিয়া।

ই-মেইল: nazirbau@gmail.com