পারস্য উপসাগরের একপ্রান্তে কুয়েতের অবস্থান। দেশটির আয়তন ১৭ হাজার ৮২০ বর্গকিলোমিটার। শীত ও গ্রীষ্মকাল দুই ঋতুর দেশ। শীতে কুয়েতের মরুময় অঞ্চল কিংবা রাস্তার ধার, পার্ক, শপিংমল রঙ-বেরঙের বাহারি ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এসব কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
মরুভূমির জীবনে একটু সবুজের ছোঁয়া যে কতটা প্রয়োজন তা বোঝা গেল কুয়েতের সৌদি সীমান্তবর্তী শহর আবদালি, ওয়াফরাতে। দল বেঁধে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আসছেন এখানে। জায়গাটিতে আসতে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়েই দেখা মেলে সবুজের। পরিবার-পরিজন নিয়ে কিছুটা সময় মনটাকে সবুজ করে ফিরছেন নিজ গন্তব্যে।
রঙ-বেরঙের ফুলের গাছ দিয়ে সাজানো দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাহারি গাছ কিংবা সবুজায়নে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দিনরাত শ্রম দিচ্ছেন। এসব শ্রমিক ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা কাজ করেনি। কুয়েতি ৬০ থেকে ৭৫ দিনার পর্যন্ত বেতন দেয়া হয়। এ ছাড়া ১২ ঘণ্টা ডিউটি করলে ১০০ থেকে ১১০ দিনার পর্যন্ত অতিরিক্ত বেতন দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৬ থেকে ৩৪ হাজার টাকা। নিজেদের জীবনটাকেই রুক্ষ আর মরুভূমি করে তপ্ত বালুতে সবুজের ফুল ফোটান বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
এসব রুক্ষ, ধূসর মরুভূমি সবুজে ঢেকে দিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকরা। বহু বাংলাদেশি সেখানে কাজ করছেন কৃষি শ্রমিক হিসেবে। গ্রিন হাউজের মতো ঘর তৈরি করে মরুভূমির বুকে ফসলের এই হাসি ফুটে উঠছে তাদের শ্রম আর ঘামে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক জানান, এই একই ভিসায় ভারত কিংবা নেপালের শ্রমিকরা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় কুয়েতে আসে। অথচ বাংলাদেশিরা আসে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে। কিছু ভিসা ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশিদেরকে বেশি টাকা দিয়ে আসতে হয়। ভারত ও নেপালে শ্রমিকরা যেভাবে কম খরচে তাদের এজেন্সির মাধ্যমে আসে আমাদের সরকারও যদি সেই উদ্যোগ নেই তাহলে বাংলাদেশিরাও কম খরচে আসতে পারবে।
এসব শ্রমিকেরা বলেন, আদম দালালের লোভনীয় ফাঁদে পড়ে ধার-দেনা করে এসস বাংলাদেশি বিপাকে পড়ে। প্রচণ্ড শীত কিংবা গরমে এত কম বেতনে এসে ঋণের টাকাতো পরিশোধ করতে পারেই না বরং তারা নানা হয়রানির মুখোমুখি হয়।
কোম্পানির কিছু অসাধু কর্মকর্তা স্থানীয় শ্রমিক আইনের বাইরে আকামা দিয়ে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। পরে ওই কর্মকর্তারাই অতিরিক্ত অর্থ দাবি করে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। আর এসব কারণেই অনেক শ্রমিক আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।
কুয়েতের আবদালি, ওয়াফরা, মরুভূমিতে বিশাল এলাকাজুড়ে শীতকালীন বিভিন্ন শাক সবজি ও ফুলের বাগান গড়ে তুলেছে। আবদালি ব্লু লাইক ফার্ম নামের একটি মাজরায় (বাগানে) কাজ করা বাংলাদেশি আরিফ, মামুন ও মোস্তফা বলেন, বিশাল এলাকাজুড়ে আমরা জুলাই থেকে কাজ শুরু করি। বিভিন্ন ফুল ও ফলের চারা রোপণ ও নানা ধরনের শীতকালীন শাক সবজির পরিচর্যা করি ডিসেম্বরের শেষের দিকে। কুয়েতিরা চায় তাদের গাছগুলো যেন সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখি।
ফসলের খেত ছুঁয়ে সবুজের স্পর্শ নেবার পাশাপাশি মরুভূমিতে নেন বুকে ভরে নিঃশ্বাস। অনুভব করেন দেশের মাটির গন্ধ। চারদিকে সবুজ আর সবুজ দেখে মনে হয়, যেন মরুভূমি নয়, সুজলা সুফলা বাংলার বুকেই আছেন তারা। ফেরার পথে গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যান টাটকা শাক সবজি।
জানুয়ারি থেকে শুরু করে পুরো শীতের সময় কুয়েতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে স্থানীয়রা কিংবা আরাবীয়ানরা বিভিন্ন দেশ থেকে ঘুরতে আসে। বাগান থেকে সতেজ সবুজ শাক সবজি ও ফলমূল কিনে নিয়ে যায়। বাংলাদেশি শ্রমিকদের শ্রমে যেন মরু এলাকা সবুজে ছেয়ে গেছে। ওয়াফরা ও আবদালিতে উৎপাদিত এসব শাক সবজি, ফুলমূল কুয়েতের বিভিন্ন সুপারশপে বাজারজাত করা হয়।
কুয়েত থেকে সাদেক রিপন