বহুল আলোচিত বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ফের মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার আড়িয়ল বিল নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। যদিও এর আগে একই স্থানে বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয়দের আন্দোলনের মুখে পিছু হটতে হয় সরকারকে।
কিন্তু এখন স্থানীয়রাই উল্টো বিমানবন্দর নির্মাণের দাবিতে সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ফের আড়িয়ল বিলকে বিবেচনায় নিয়েছে সরকার। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ে অনুমোদন পেলে আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মহিবুল হক বলেন, ‘বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য আমরা কিছু জায়গা বাছাই করে রেডি (প্রস্তুত) রেখেছি। পদ্মার ওপারে শিবচরের চরজানাজাতও ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এত লোক উচ্ছেদ করে আমি বিমানবন্দর করব না।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমে যে স্থানটি ঠিক করেছিলাম আড়িয়ল বিল, সেখানে এখন চেষ্টা চলছে। এখন সেখানকার লোকজন স্বেচ্ছায় জায়গা দিতে চাচ্ছেন। এখন আমরা কোথাও কিছু করলে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে, তাদের মতামতের ভিত্তিতেই করব।’ ‘আমরা আড়িয়ল বিল নিয়ে চিন্তা করছি। কিন্তু এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন প্রয়োজন।’
সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ‘(আড়িয়ল বিল এলাকার) স্থানীয়রা এখন মিছিল-মিটিং করছেন। তারা বলছেন, আমাদের এখানে করেন। স্মারকলিপিও দিয়ে গেছেন।’
বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান কাজ করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাচ্ছেন। আগে বিমানবন্দর করতে না দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী কষ্ট পেয়েছেন, তাই তিনি এখন রাজি হচ্ছেন না। প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন, তারা একবার না করে দিয়েছে, করতে দেয়নি। এখন চাইছে, দেব না। শিল্প উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীকে নরম করার চেষ্টা করছেন।’
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই একটি সর্বাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়, যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি হবে আঞ্চলিক সংযোগের গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এর নাম ঠিক করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। কিন্তু নানা জটিলতায় বিমানবন্দর নির্মাণে এখনও উপযুক্ত একটি স্থানই নির্বাচন করা যায়নি।
বিমানবন্দরের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করতে বিমান মন্ত্রণালয়ের তখনকার যুগ্ম সচিব জয়নুল আবেদীন তালুকদারকে প্রধান করে একটি সেলও গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য কয়েকটি স্থান প্রাথমিকভাবে বাছাই করে সেই সেল। প্রথম প্রস্তাবে ছিল ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ত্রিশাল, আমিরাবাড়ী ও মঠবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজার দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জমি। এরপরের প্রস্তাবে ত্রিশাল উপজেলার রামপাল, কানিহারি, কাঁঠাল ও বৈলা ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজার দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জমি। এছাড়া টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১০ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট চর এলাকাও এ বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য বাছাই করা হয়।
কিন্তু একটি স্থানও পছন্দ করেননি প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি ঢাকার আশপাশে স্থান নির্বাচনের নির্দেশ দেন। ঢাকার দোহার উপজেলার চরবিলাশপুর, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ও লতব্দী, আড়িয়ল বিল, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার চর জানাজাত, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের রাজৈর, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বাঘিয়ার বিল, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এবং মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরকে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বেছে নেয় নতুন বিমানবন্দর গঠন সংক্রান্ত সেল।
২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সিগঞ্জের আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের নীতিগত অনুমোদন দেন।
তখন বলা হয়েছিল, প্রস্তাবিত বিমানবন্দরটিতে তিনটি রানওয়ে থাকবে। বিমানবন্দরের জন্য প্রস্তাবিত জমির পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার একর। ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মাধ্যমে বিমানবন্দরটি নির্মাণ হবে। বিমানবন্দর ঘিরে হবে বঙ্গবন্ধু সিটি। বঙ্গবন্ধু সিটিতে থাকবে পর্যটন কেন্দ্র, মনোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সুবিশাল বাণিজ্যিক ভবন, খেলার মাঠ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, নিরাপত্তাবেষ্টনী, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক ভবন।
কিন্তু স্থানীয়রা আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা শুরু করেন। আন্দোলনে নামেন তারা। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয়দের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। নিহত হন এক পুলিশ সদস্যও। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ হবে না বলে ঘোষণা দেন।
এরপর অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে বিমানবন্দর নির্মাণ কার্যক্রম। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে ১৩৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার পশ্চিম পাড়ে জাজিরা ও শিবচরের চরজানাজাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার কাজ পায় জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়ি। শিবচরকে চূড়ান্ত ধরে এগিয়ে যায় প্রকল্পের কাজ, ব্যয় হয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা।
কিন্তু এখানেও জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়দের কাছ থেকে বাধা আসে। সরকারে পক্ষ থেকে বলা হয়, শিবচরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানবন্দর করলে প্রায় আট হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে। তাই শিবচর থেকেও সরে আসে সরকার।
সৌজন্যে- জাগো নিউজ