নাইট ডিউটি শেষ করে চোখের পাতা কেবল মেলেছি। এরই মধ্যে কাশেম ভাইয়ের কল। বছর তিনেক আগে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান কাশেম। ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল। কল ব্যাক করে জিজ্ঞেস করলাম কী
সমস্যা ভাই। জবাবে বললেন খুবই খারাপ সংবাদ। শোনার পর আমি নড়েচড়ে বিছানায় উঠে বসলাম। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল জলধারা বয়ে যাচ্ছে।
আজকাল খারাপ সংবাদ শুনলেই কেন জানি ভয় লাগে। করোনাভাইরাসের কারণে বুকটা সবসময় কেঁপে উঠে। দেশটিতে কয়েজন বাংলাদেশি আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে সবসময় আতঙ্কে থাকি। কাশেম ভাই বললেন আজ এমদাদ ভাই দেশে চলে যাচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়াই কোম্পানি তাকে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অবিশ্বাসের স্বরে বললাম কী বলছেন এসব!
গতকালই তো ওর সঙ্গে কথা বললাম। দেশে যাওয়ার বিষয়ে এমদাদ কিছুই বলল না। কাশেম ভাই বলল আজ সকালেই কোম্পানির এইচআর এমদাদকে ডেকে জানিয়েছে বিকেল সাড়ে তিনটায় তোমার ফ্লাইট। তোমাকে দুই ঘণ্টা সময় দেওয়া হলো বাসায় গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানতে চাইলাম এমদাদ এখন কই? সে এখন সিকিউরিটি গেটে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছে। লাইনটা কেটে দিয়ে একটি গেঞ্জি গায়ে জড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে নিচে নেমে গেলাম।
গিয়ে দেখি এমদাদ সিকিউরিটির সঙ্গে কী যেন আলাপ করছে। আমাকে দেখে সিকিউরিটির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে এমদাদ একপাশে চলে আসলো। আমার চোখে চোখ পড়তেই ওর মুখে ম্লান হাসি ফুটে উঠল। আমি কী যে বলব ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। গতকালই ও আমাকে ওর স্বপ্নের কথা বলেছে আর আজ সেই স্বপ্নগুলি অধরা রেখেই চলে যেতে হচ্ছে। হায়রে প্রবাস জীবন!
এমদাদই আগে বলল ভাই চলে যাচ্ছি, দোয়া করবেন। এই কথা বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভেবেছিলাম ও কেঁদে ফেলবে কিন্তু না ও মানসিকভাবে খুবই শক্ত একজন মানুষ। আমাকে অবাক করে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু আপনার মুখ এত ভার কেন, দেখে তো মনে হচ্ছে আমি না আপনিই চলে যাচ্ছেন।
আমি কিছু বললাম না কারণ আমি জানি স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা কত ভয়াবহ। প্রত্যেকটা প্রবাসীর কিছু নির্দিষ্ট স্বপ্ন থাকে আর সেই স্বপ্ন পূরণ না হলে তারা যে যন্ত্রণা পায় তা প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই।
এমদাদ নির্ধারিত স্মোকিং জোনে গিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে মুখভর্তি করে ধোঁয়া ছাড়ছে আর মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমি পাশেই দাঁড়িয়ে তাকে অবজার্ভ করছি। গতকালই এই ছেলেটি আমাকে বলেছিল, ‘ওমর ভাই যত টাকা লোন করে এখানে এসেছিলাম লোনের সেই টাকা মাত্র পরিশোধ করলাম। এখন বাবার চিকিৎসা করাতে হবে বাবা কতদিন যাবত ঘর থেকে বের হতে পারছে না, নামাজ পড়তে গিয়ে পিছিল রাস্তায় পা ছিটকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছি’।
‘প্রথম ভেবেছিলাম পা মচকিয়েছে তাই ঝাড়ফুঁক করা হয়েছিল এখন মনে হচ্ছে অবস্থা খারাপ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমার কাছে টাকা ছিল না বলে এতদিন হাসপাতালে নিয়ে যেতে তোড়জোড় করিনি। চিন্তা করছি এই মাসের বেতন পেলেই বাবার চিকিৎসা করাব আর আগামী মাসে মায়ের চিকিৎসা। মা আজকাল চোখে কম দেখে তাই তাকে চোখের ডাক্তার দেখাতে হবে’।
তার কথা শুনে আমি জবাবে বলেছিলাম সবকিছু আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তার করার কিছু নেই। এমদাদ বলেছিল ‘মা বাবার চিকিৎসার পর বাড়িতে সুন্দর করে ঘর করব। ঘরটা করা হলেই বাড়িতে গিয়ে বিয়ে করব’।
এমদাদের গলার খাঁকাড়িতে কল্পনা জগত থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম। এমদাদ বলল ভাই আপনি এত মন খারাপ করে আছেন কেন। আমি অপ্রস্তুতভাবে জবাব দিলাম কই না তো। নীরবতা! দু’জনের কারো মুখে কথা নাই। আমিই বললাম ভাই হঠাৎ করে পাঠিয়ে দেবার কারণ কি?
এমদাদ জবাব দেয় কারণ তো অবশ্যই আছে তবে আপনাকে বলা যাবে না, এমনিতেই জেনে যাবেন। তবে সবচেয়ে খারাপ লাগল কোম্পানি আমাকে সুযোগ দিল না। হঠাৎ ডেকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দুই একদিন আগে বললেও বাড়ির জন্য কিছু কেনাকাটা করতে পারতাম। এখন কিছু যে কিনব তার কোনো সুযাগ নেই।
যেভাবে খালি হাতে এসেছিলাম সেভাবে খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছি। মা বাবার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। আমি কাঁধেচাপা দিয়ে বললাম তাতে সমস্যা নেই এখন দিতে পারেননি অন্য সময় দেবেন। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমদাদ বলল ভাই আজ যাই গাড়ি চলে এসেছে। আশাকরি নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন। বহুকষ্টে নিজেকে সংযত রেখে তাকে বিদায় দিলাম।
আমি ভাবতেই পারছি না স্বপ্নভঙ্গ ছেলেটি এমন হাসিখুশিভাবে আমার কাছ থেকে বিদায় নেবে। কবি বলেছেন মানুষ নাকি স্বপ্নই দেখে তা ভঙ্গের জন্য। তবুও তারা স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘ আড়াই বছর ও আমাদের সাথে ছিল। এতদিন পাশাপাশি থাকাতে ওর প্রতি একধরনের মায়া তৈরি হয়েছিল। জীবন মানেই মায়া। উল্লেখ্য, কোম্পানির নিজস্ব আইনবিরোধী কোনো কিছু করলে পূর্ব নোটিশ ছাড়াই শ্রমিকদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
লেখক- ওমর ফারুকী শিপন, সিঙ্গাপুর