প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ লকডাউনের পথে হাঁটলেও এখনও ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে ইউরোপের দেশ সুইডেন। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন ঘোষণা না করে জনগণকে সতর্কতার সঙ্গে দৈনন্দিন কাজ করতে বলা হয়েছে। ৭০ বছরের বেশি বয়সীদের ঘরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে। যাদের পক্ষে সম্ভব তাদেরকে ঘরে থেকে কাজ করা এবং জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে সরকার।
তবে করোনার আঘাতে প্রতিদিন এখানে প্রাণহানি আর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় জনজীবনে নেমে এসেছে স্থবিরতা। অতি প্রয়োজন ছাড়া মানুষজন এখন ঘর থেকে বের হয় না। ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সুইডেনের যোগাযোগ কার্যত এখন বন্ধ হওয়ায় টুরিস্টের ওপর নির্ভরশীল প্রায় সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সুইডেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের একটা বিশাল অংশ কাজ করেন রেস্টুরেন্ট। এখানে পড়তে আসা অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে, অস্থায়ী কাজের অনুমতি পান। যাদের বেশিরভাগই রেস্টুরেন্টে কাজ করার সুবাধে এই পারমিট পেয়ে থাকেন। এখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য তাদেরকে একটা নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
প্রথমত, তাদের কমপক্ষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতনের কাজ পেতে হয়। প্রথম দুই বছর একই কোম্পানিতে কাজ করার নিয়ম আছে বা অতি প্রয়োজনে কাজ পরিবর্তন করতে হলে আগের কোম্পানি থেকে নতুন কোম্পানিতে বেশি বেতন পেতে হয়। কারও কাজ চলে গেলে বা কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে নতুন কাজের চুক্তিপত্রসহ ইমিগ্রেশনের আবেদন করতে হয়। এ সব শর্ত পূরণ করতে না পারলে দেশটিতে প্রবাসীদের ভিসা বাতিল হয়ে যায়।
বাংলাদেশ থেকে পড়তে এসে ওয়ার্ক পারমিটে থাকা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এক বছর আট মাস যাবত ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে আছি। আর চার মাস পরই ভিসা নবায়ন করার কথা। কিন্তু গত এক মাস যাবত আমার প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। একদিকে কাজ নাই, অর্থনৈতিক সমস্যায় আছি। অন্যদিকে, নিজের ভিসা টিকিয়ে রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। আগামী দুই মাসের মধ্যে নতুন কাজ না পেলে ভিসা বাতিল হবে। এখন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি।’
করোনাভাইরাস মহামারিতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় অনেকের কাজ চলে যাচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ না হলেও তাদের ব্যবসা সীমিত হয়ে আসায় কাজ কমে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এই মুহূর্তে কারও কাজ চলে গেলে নতুন করে কাজ পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
সুইডিশ সরকার করোনা মহামারি মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপ নিলেও তাতে মূলত ব্যবসায়ী এবং স্থায়ীভাবে বসবাসকারীরা এ সুবিধা পাচ্ছেন। স্থানীয় পত্রিকা, টেলিভিশনে এ নিয়ে প্রতিদিনই আলোচনা হচ্ছে। মানবাধিকার এবং অভিবাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে অভিবাসীদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে দাবি জানিয়ে আসছে।
উন্নত জীবন আর ভালো উপার্জনের আশায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নতুন বাংলাদেশিরা আছেন বিপাকে। অনেকেই বেকার হয়ে পড়ছেন। বসবাসের অনুমতির জন্য ইমিগ্রেশনে আবেদন করেছেন এখনও অনুমতি পাননি এমন অনেকেই আছেন নানামুখী সংকটে। কাজের চুক্তিপত্র থাকলেও এখনও বসবাসের অনুমতি না হওয়ায় সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন না।
ইতালি থেকে আসা কবির হোসেন বলেন, ‘ইতালির সরকার সবাইকেই সহযোগিতা করছে। সেখানে থাকলে এতো চিন্তা থাকত না। দুই মাস যাবত করোনার কারণে আমাদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ আছে। কাজ নেই দুই মাস হলো। এখানে বসবাসের অনুমতি সহসা পাব না। এই মুহূর্তে ইতালি ফিরে যাওয়াও সম্ভব না। সুইডিশ সরকার আমাদের ইউরোপের রেসিডেন্সধারীদের জন্য একটা ভালো সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।’
দেশটিতে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস করা অনেকেই আছেন যারা কিছুদিনের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করবেন, তারাও এক কঠিন সময় পার করছেন।
ছয় বছর যাবত সুইডেনে থাকা রাহুল সরকার বলেন, ‘এখানে পড়াশুনা শেষ করে প্রায় চার বছর হলো ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করছি। আগামী মাসে পার্মানেন্টের জন্য আবেদন করার কথা। এখন কাজ বন্ধ। সরকার কোনো সিদ্ধান্ত না নিলে দেশে ফিরে যেতে হয় কি না এমন অনিশ্চয়তায় আছি।’
উত্তর ইউরোপের দেশ সুইডেনে অর্থনীতিকে সচল রাখতে লকডাউন না করার এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক অনেক হলেও এখনই বলা যাবে না সুইডেনের সিদ্ধান্ত উপযুক্ত ছিল কি না। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, যারা টেম্পোরারি ওয়ার্ক পারমিটে আছেন, তারা যদি সুযোগ পায় অন্তত এক ভাগ কাজও করার সুযোগ যদি থাকে সেটা যেন করে যায়।
উল্লেখ্য, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সুইডেনে এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ২০০ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। আর প্রাণ গেছে প্রায় ১ হাজার ৪০০-এর মতো মানুষের।